দৃষ্টিপাত

‘জয় বাংলা’র অর্থ তাহলে কী হবে?

Looks like you've blocked notifications!

‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি এখন অতীত হওয়ার পথে। বিধানসভায় সদস্যদের ভোটে নাম বদলে এখন ওপার বাংলা ‘বাংলা’ হলো বটে, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নাম প্রতিষ্ঠা পেতে অনুমোদন লাগবে ভারতের রাষ্ট্রপতির। সেই অনুমোদন পেলে ইংরেজিতে হবে ‘বেঙ্গল’ আর হিন্দিতে ‘বঙ্গাল’। এই নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসে যায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। কারণ দুটি নামের মিল। বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে প্রতিক্রিয়া জানানো। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই।

শুরুতেই বলা যায় ‘জয় বাংলা’র কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পশ্চিমবঙ্গের (সাবেক!) নাম যখন ‘বাংলা’, তখন আপনি ‘জয় বাংলা’ বলে উঠলে তার অর্থ কোথায় গিয়ে ঠেকবে? আবেগ আর অনুভূতির কথা একটু না হয় পাশেই ঠেলে রাখি, লিখিত বা আনুষ্ঠানিক কোনো ফরম্যাটে এই সংলাপের কী দাঁড়াবে? এ বিষয়ে চিত্রশিল্পী এবং প্রকৌশলী মুস্তফা খালিদ পলাশের কথা হচ্ছে, ‘আমার সোনার বাংলা’ কথাটির ওপর এখন অধিকারবোধ প্রকৃতপক্ষে কার হবে, এমনই এক সংশয় তৈরি করতে যাচ্ছে এই নামকরণ। তিনি বলেন, “আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ ঠিক জাতীয় সংগীতের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা হয়নি, যেমনটা কিনা ‘জন গণ মন’ লেখা হয়েছিল উদ্দেশ্যমাফিক। যখন আমরা ‘বাংলা’ উচ্চারণ করি, তখন ‘দেশ’ সংযুক্তিটি ব্যতিরেকেই আমরা একে আমাদের রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করি। একটি রাজ্যের তিনটি ভাষায় তিনটি নামের কোনো প্রয়োজনই তো দেখি না। পৃথিবীর কোনো জায়গাতেই আমি এমন কোনো ঘটনার কথা শুনিনি। এটা স্রেফ ভ্রান্তি তৈরি করবে এখন। মানুষ যখন ‘জয় বাংলা’ বলবে, তার অর্থ আসলে কী দাঁড়াবে?” টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদক প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তকে এমন প্রশ্নই করেন তিনি।

একই প্রতিবেদনে দেখা যায়, লেখিকা, সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী ফারাহ গজনবী ‘বাংলা’ করার সিদ্ধান্তকে একেবারেই অপ্রযোজনীয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে অভিহিত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ্যা বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান নাম বদলের বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও ‘বাংলা’ নামকরণটিকে মোটেও সমর্থন জানাচ্ছেন না। “এই নামটি (বাংলা) ব্যবহারের ফলে বেশ কিছু জায়গাতেই অবধারিতভাবে সমস্যা সৃষ্টি হবে, আমাদের জাতীয় সংগীতে তো বটেই। ‘বাংলা’ একটি ভাষার নাম। অন্য দেশের মানুষ তো এমন নামকরণ হলে গুলিয়ে ফেলবে যে কোনটি ভাষা আর কোনটি রাজ্যের নাম! ‘বঙ্গদেশ’ নামকরণটি শ্রেয়তর ছিল” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচনাকাল ১৯০৫। ব্রিটিশরা যখন অবিভক্ত বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে, তখনই এই গান লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে এটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

অবশ্য সবাই যে জাতীয় সংগীতে ‘দ্বিধা’ সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন, বিষয়টি এমন নয়। সাংবাদিক ও লেখক আনিসুল হক এবং অভিনয়শিল্পী সোহানা সাবা মনে করেন, কোনো ধরনের নামকরণই আমাদের জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা সৃষ্টি করতে পারবে না। নাম বদলানোর বিষয়টিকেও তাঁরা সাধুবাদ জানান, তবে ‘বাংলা’ নামকরণটিকে তাঁরা ঠিক সমর্থন করতে পারেননি। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে তাঁদের এই প্রতিক্রিয়া।

‘বাংলা’ নামকরণটি যে এরই মধ্যে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। কেন্দ্র ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন চাই এ জন্য। এটি পেয়ে গেলেই ‘বাংলা’ নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাবে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে বা বিষয়টি কোন ধরনের দ্বিধা সৃষ্টি করতে পারে, তা নিয়ে কোনো ধরনের বক্তব্যের ধারেকাছেও যাননি তৃণমূল নেতারা।

নামকরণের রাজনীতি আমাদের এই অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। ভাষার বিষয়টি সব সময়ই কর্তৃত্ব স্থাপনের ক্ষেত্রে সুচতুর এক হাতিয়ার। ‘বঙ্গ’ বা ‘বঙ্গদেশ’ না রেখে সরাসরি ‘বাংলা’ তথা একটি ভাষার নামে রাজ্যের নাম দেওয়াটিকে কি বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয় না?

জাতীয় সংগীতে, কোনো বিশেষ সংলাপে অথবা আমাদের প্রতিদিনের কথায়— বাংলা কিন্তু আর শুধু আমাদের বাংলা থাকছে না, অন্য কোনো বাংলাও সেখানে জড়াতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু বাংলা নামটি জড়িত তাই এ দেশের মানুষেরও মতামতটি জরুরি, এটা ওপার বাংলার নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক