পাহাড়ের পর্যটন : হতাশার গল্পই চারদিকে

Looks like you've blocked notifications!
পানিতে ডুবে আছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু। ছবিটি ১৯ সেপ্টেম্বর তোলা। এনটিভি

প্রকৃতি উজাড় হাতেই সাজিয়েছে যে জেলাকে, তারই নাম রাঙামাটি। প্রায় ৭০০ বর্গকিলোমিটারের সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদের নীল জলরাশি আর হ্রদের পাড়ের সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা যে জেলাকে সারা দেশের চেয়ে একেবারেই ভিন্নতর করে সৃজন করেছে, সেই জেলাটিই হতে পারত দেশের পর্যটনের আইকন। 

কিন্তু রূঢ় কঠিন বাস্তবতা হলো, অরণ্যসুন্দরী এই জেলায় পর্যটক আগে যেমন আসত, এখন আর তাও আসে না। দিনের পর দিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মানুষের ঘৃণ্য থাবা আর বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য নতুন কোনো স্পট বা সুবিধা গড়ে না ওঠায় রাঙামাটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। তাই এখন আর আগের মতো রাঙামাটি আসে না পর্যটকরা। একবার যিনি ঘুরে গেছেন, তিনি আর দ্বিতীয়বার আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। 

নিয়মিতই ডুবছে ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’ ঝুলন্ত সেতু !
সেই আশির দশকে নির্মাণের পর থেকেই রাঙামাটি বলতেই সারা দেশের মানুষের কাছে যে ছবিটি ভেসে ওঠে সেটি হলো রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ভেতরে অবস্থিত একটি ঝুলন্ত সেতু। রাঙামাটিতে বেড়াতে এসেছে কিন্তু এই সেতুতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেনি এমন পর্যটক বিরল। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। গত এক দশক ধরেই প্রায় নিয়ম করেই পানিতে ডুবছে সেতুটি। বর্ষার সময়ে অন্তত মাসখানেক পানির নিচে পড়ে থাকে সেতু। ফলে ওই সময় বেড়াতে আসা পর্যটকরা হতাশ মনে ফিরে যায়। কিন্তু বছরের পর বছর সেতুটি নিয়মিতভাবে ডুবলেও এটির সংস্কার কিংবা কিছুটা ওপরে তোলার কোনো চেষ্টাই নেই!

বিড়ম্বনার নাম ‘শুভলং ঝরনা’ ও হ্রদ ভ্রমণ 
রাঙামাটিতে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ কাপ্তাই হ্রদে নৌ ভ্রমণ। বেড়াতে আসা পর্যটন এলাকা কিংবা তবলছড়ি ও রিজার্ভবাজার থেকে ইঞ্জিনবোট ভাড়া করে শুভলং পর্যন্ত যায়। যাওয়া আর আসায় প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ গত ৪৪ বছরেও এই নৌভ্রমণের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পর্যটকবান্ধব স্পিডবোট চালু করা গেল না। ফলে ইঞ্জিনবোটের টানা তীব্র শব্দ পর্যটকদের হ্রদ ভ্রমণের আনন্দটাই মাটি করে দেয়। তার ওপর সবচেয়ে কষ্টের হয়ে দাঁড়ায় গন্তব্যে পৌঁছানোর পর শুভলং ঝরনায় পানি না থাকায়। বছর কয়েক আগেও শুভলং ঝরনায় সারা বছর পানিপ্রবাহ থাকলেও এর উৎসমুখে সেচের পানির জন্য বাঁধ নির্মাণ, এর আশপাশের এলাকার গাছ উজাড় এবং কথিত উন্নয়নের কারণে প্রাকৃতিক অবয়ব নষ্ট হওয়ার পর এখন শুধু বর্ষাকালেই পানি থাকে শুভলংয়ের দুটি ঝরনায়। ফলে বছরের বাকি নয় মাস রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের  ‘বেদনা’ আর ‘বিড়ম্বনা’র নাম  কাপ্তাই হ্রদ ভ্রমণ এবং শুভলং ঝরনায় যাওয়া। 

বেসরকারি উদ্যোগ আছে, পৃষ্ঠপোষকতা নেই
এ কথা সত্য যে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। পার্বত্য জনপদ রাঙামাটিতে কিছু কিছু বেসরকারি উদ্যোগ আছেও। সরকারি উদ্যোগের একমাত্র পর্যটন কমপ্লেক্স ছাড়া আর যাই আছে সবই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। হ্রদের পাড়ের পেদা টিং টিং, টুকটুক ইকো ভিলেজ, গর্বা রিসোর্ট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, চাংপাং, রাইন্যাটুগুন সবই গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাতেই। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, এসব স্থাপনার উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে কষ্ট পেলেও তাঁদের জন্য নেই কোনো ঋণের সুব্যবস্থা  কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা। বরং আছে নানান নির্দেশনা আর খবরদারি। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট  বিভাগ একটু সহায়তা করলেই এই সব ব্যক্তি উদ্যোগগুলো আরো বিকশিত হয়ে গতি পেত এবং ভূমিকা রাখতে পারত পর্যটন শিল্পে। এমনকি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ওপর নির্ভরশীল টেক্সটাইল শিল্পেও নেই সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। 

বনবিহার কর্তৃপক্ষের বাগড়া!
রাঙামাটি বেড়াতে এসে শহরের ঝুলন্ত সেতু ও শুভলং ঝর্ণার পরই পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান ছিলো শহরের রাজবনবিহার। আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম নির্মাণশৈলীর কারণে বিখ্যাত এই বিহারেই মমি করে রাখা হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় সাধুপুরুষ বনভন্তেকে। দেশে এটাই প্রথম কোনো মমি। গ্লাসের বক্সে রাখা এই ধর্মীয় গুরুর মমি দেখতে প্রতিদিনই অসংখ্য নারী পুরুষ সমবেত হতো বৌদ্ধ বিহারে। বিহারের ভান্তেদের বিশ্রামের সময় বাদে সকাল ৯টা থেকে ১২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্তই ছিল বিহার প্রাঙ্গণ বছরের পর বছর ধরেই। কিন্তু মাস কয়েক আগে হঠাৎ করেই বিহারে পর্যটক ও দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিহার কর্তৃপক্ষ। ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় এই স্থানটিতে এখন আর প্রবেশ করতে পারছে না পর্যটকরা। 

সন্ধ্যে হলেই প্রাণহীন শহর
এখনো  প্রতি মৌসুমেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক অজানা কারণে ছুটে আসে রাঙামাটি। কিন্তু সারাদিন ইতিউতি ঘুরে বেড়ালেও সন্ধ্যে হতেই অস্বস্তি ঘিরে ধরে তাদের। সন্ধ্যের পর টেক্সটাইল মার্কেটে কিছু কেনাকাটা ছাড়া কিছুই করার নেই তাদের। নেই কোনো সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক আয়োজন, চাইলেই রাতে খেতে পারবে না ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে, অনেক খুঁজেও পাওয়া দুষ্কর বিয়ার বা অন্য কোনো পানীয়। শুধু তাই নয়, রাত ৮টার পর শহরে চলাচল করার গাড়ি পাওয়াও দুষ্কর! ফলে একবার রাঙামাটি আসা পর্যটক দ্বিতীয়বার আসতে অনাগ্রহীই হয়ে ওঠে। 

নেই পর্যটকবান্ধব গণপরিবহন!
রাঙামাটি আসার জন্য ঢাকা থেকে সকাল আর রাত ছাড়া গাড়ি নেই। ফলে কেউ চাইলেই  দিনের যেকোনো সময় রাঙামাটির উদ্দেশে রওনা হতে পারবে না সরাসরি। আসতে হবে চট্টগ্রাম হয়ে। চট্টগ্রাম আসার পর রাঙামাটি আসতে যেসব গাড়ি ‘পাহাড়িকা’ বা ‘বিরতিহীন’ নামে যেসব বাস চলছে সেগুলোকে মরণফাঁদ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আঁটোসাঁটো সিট, বেপোরোয়া চালক আর লক্করঝক্কর গাড়ি পাহাড়ি পথে আপনার ভ্রমণকে যেমন বিপদগ্রস্ত করবে, তেমনি চলার পথের সৌন্দর্যকেও বিষের কাঁটার মতোই মনে হবে। ঢাকা থেকে ৩৭০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে রাঙামাটি এসেও স্বস্তি পাবে না। এখানে পুরো শহরটাই অটোরিকশা চালকদের কাছে জিম্মি। শহরের অভ্যন্তরীণ চলাচলের একমাত্র বাহন হওয়ায় এদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার তো পাবেই না, বরং উল্টাপাল্টা ভাড়া নিয়ে নাভিশ্বাস তুলে পর্যটকদের। স্থল ছেড়ে জলে নামবে,সেখানেও স্বস্তি নেই। চাইলেই নিজের পছন্দের বোট নিয়ে নৌভ্রমণে যেতে পারবে না। কথিত সমিতির নির্ধারিত ভাড়াতেই এবং তাদের নির্ধারিত বোটেই পর্যটককে হ্রদের প্রায় পাঁচ ঘণ্টার ভ্রমণে যেতে হবে। সেই বোটে লাইফ জ্যাকেট আছে কি না কিংবা বোটের বসার অন্যান্য সুবিধা আদৌ শতভাগ ঠিক আছে কি না,সেটা দেখারও কেউই নেই। এত বছরেও গড়ে উঠেনি পর্যটকবান্ধব পরিবহন, সেটা জলে হোক বা স্থলে, দীর্ঘপথে কিংবা স্বল্পপথে। 

আছে ভয়, আছে চোখ রাঙানি!
আবার রাঙামাটি বেড়াতে হয়তো আসবেন, কিন্তু সবখানে যেতে মানা! না, সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়। স্বআরোপিত নিষেধাজ্ঞা। পাহাড়ের প্রভাবশালী আঞ্চলিক দলগুলো এখানে পর্যটন শিল্প বিকাশের বিরোধী। ফলে তারা সর্বত্র পর্যটকদের অবাধ আনাগোনাকে স্বাগত জানায় না। ফলে চাইলেই যাওয়া যায় না অচেনা কিংবা নতুন আবিষ্কৃত কোনো ঝরনায়। চাইলেই বনে বাদাড়ে  ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়। পথ চলতেই দেখা হয়ে যেতে পারে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সঙ্গে, যা পর্যটকদের জন্য স্বস্তির নয় মোটেই। এসব ভয় আর চোখ রাঙানির কারণে সাজেক যেতে এবং আসতে হয় সেনা প্রহরায়, বেড়াতে আসা বিদেশি পর্যটকদের নিতে হয় আগাম অনুমতি এবং তাঁদের পেছনে সর্বক্ষণ লেগে থাকে নিরাপত্তাকর্মীরা। আর যাই হোক নিরাপত্তা প্রহরায় নিশ্চয়ই ভ্রমণবিলাস সম্ভব নয়। এরই মধ্যে আবার গত দুই বছরে শহরের তিনটি আবাসিক হোটেলে তিনটি পৃথক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং পর্যটন কমপ্লেক্স এলাকায় দুটি হত্যাকাণ্ড পর্যটন শিল্পে সংকটই বাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে পাহাড়ের তিন আঞ্চলিক দলের নিজেদের মধ্যকার প্রতিদিনের খুন, অপহরণ আর সংঘর্ষের সংবাদ গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় ভয় ছড়িয়েছে সর্বত্রই। 

তবু আশাবাদ
হয়তো হতাশার গল্পটাই বেশি। তবু আশাবাদের মতো ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি বাঘাইছড়ির সবুজ উপত্যকা সাজেক নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেখানে নির্মিত হচ্ছে পর্যটকবান্ধব স্থাপনা। রাঙামাটি-কাপ্তাইয়ের ১৯ কিলোমিটারের নয়নাভিরাম সড়কটি দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পর্যটন নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেই পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাহাড়ের পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে সেমিনার হয়েছে, সেই সেমিনারের সুপারিশগুলো নিয়ে শুরু হয়েছে একটি ‘মাস্টারপ্ল্যান’ এবং ‘পাহাড়ের জন্য পৃথক পর্যটন নীতিমালা’ প্রণয়নের কাজ। 

রাঙামাটি  পার্বত্য জেলা পরিষদের বৃষ কেতু চাকমা বলেছেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকার কাজ শুরুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। চলছে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজও। আশা করছি আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পর রাঙামাটির পর্যটন শিল্প নিয়ে যে হতাশা সেটা কেটে যাবে।’