অভিমত

প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাংলাদেশ

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে অনেক কথা ও লেখালেখি হয়েছে। তন্মধ্যে সিংহভাগ কথা বলা/লিখা হয়েছে, প্রাকৃতিক উৎস থেকে এ গ্যাস নামক পদার্থটির বিতরণ নিয়ে। কত সংগ্রাম হয়েছে, কত চুরি হয়েছে, কত কত লোক অল্পদিনেই বড়লোকে পরিণত হয়েছেন এ প্রকৃতি প্রদত্ত গ্যাসটির বিতরণ বাণিজ্য করে। এতসব কর্মকাণ্ড থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে আমরা এই প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের উত্তোলন, বিতরণ ও সঠিক কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মুন্সিয়ানা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছি। কী প্রধান কারণ হতে পারে এ ব্যর্থতার? এককথায় বলা যায়, দুর্নীতি ও হরিলুট। এ প্রাকৃতিক সম্পদ কী কাজে ব্যবহৃত হযে সেটা নিয়ে শুরুতেই দ্বিধায় ছিল তৎকালীন কর্তৃপক্ষ।

এতদঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান কি আজকের কথা? এখন থেকে ১৩৩ বৎসর আগে ১৮৮৩ সালের কথা। ইংরেজদের আমলের সেই আসাম রেলওয়ে ও ট্রেডিং কোম্পানির কথা; যারা সর্বপ্রথম ১৮৮৩ সালে হাইড্রোকার্বন ও গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষে ড্রিলিং শুরু করে। পরে অনেকটা বাণিজ্যের আশায় আসাম অয়েল কোম্পানি গঠিত হয়। তারা ১৯১১ সালের দিকে সিলেটের সুরমা বেসিন ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে তৈল ও গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি মিলে এ পর্যন্ত মোট ৬২টি কূপ খনন করা হয়েছে। তার ফসল হিসেবে আমরা মোট একটি তেল ও ২৭টি গ্যাসক্ষেত্র পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২২টি কূপ খনন করে পওয়া যায় ৮টি গ্যাসক্ষেত্র। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯২ সময়কালে ২৪টি কূপ খনন করে পাওয়া যায় ৯টি গ্যাসক্ষেত্র। আর ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল সময়কালে ১০টি কূপ খনন করে ৫টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে জ্বালানিমন্ত্রী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেই ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট ১৯৭৪ প্রণীত হয়। এর ফলেই সম্ভব হয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সুযোগ করে দেওয়া। ১৯৭৪ পরবর্তী ২০ বৎসরে ৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছিল।

এই প্রাকৃতিক গ্যাসের আছে নানাবিধ ব্যবহার। আর ব্যবহার যখন একবার শুরু হয় তা শুধু বাড়তেই থাকে। যেমন মিথেন নামে এই প্রাকৃতিক গ্যাস প্রধানত তিনটি কাজে ব্যবহার করা যায় ১. তাপ উৎপাদন, ২. বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ৩. রান্নার কাজে। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় এই প্রাকৃতিক গ্যাস প্রধানত ব্যবহার করা উচিত শিল্প কারখানায়। যেখানে তাপ ও বিদ্যুৎ একটি প্রধানতম এনার্জি সোর্স। কিন্তু আমরা এতদঞ্চলের মানুষ গ্যাস ও তেলক্ষেত্র আবিষ্কারের পর এতটাই আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম যে ঘরের বউদের স্রেফ রান্নার কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার নিমিত্তে রান্নার কাজে ব্যবহার করার জন্য এ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার শুরু করি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৫৯ সালে মাত্র একটি শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়ার পর ১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত লেখক শওকত ওসমানের ঢাকাস্ত ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাসায় সর্বপ্রথম পাইপযোগে রান্নার গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। বলতে গেলে তারপর থেকেই গ্যাস বাণিজ্য শুরু। সেই থেকে গ্যাস বিতরণ ক্ষেত্রে নৈরাজ্য শুরু। তা যেন আর শেষ হওয়ার নয়। উদাহরণস্বরূপ রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে অবৈধ গ্যাস পাইপ লাইন আছে ৩০০ কিলোমিটার।

বর্তমানে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৮০% ব্যবহৃত হয় শক্তি উৎপাদনের কাজে। দেশের মোট ব্যবহৃত গ্যাসের খাতওয়ারী হার হচ্ছে : বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৫%, সার ৩৫%, এবং শিল্প, বাণিজ্য ও গার্হস্থ ২০%। দেখার মতো বিষয় হলো বছরে ১৩.৪% হারে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে।

এই বর্ধিত চাহিদা কীভাবে পূরণ করা যাবে? বলা হয় গ্যাস সম্পদ একটি অনবায়নযোগ্য সম্পদ। মানে শেষ হয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না। সুতরাং ব্যবহারের ক্ষেত্রে হতে হবে বিচক্ষণ।

এ কথা অবধারিত সত্য যে একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সে দেশের জনগণের অধিকার রয়েছে। তবে ‘একদিনে শেষ করে দেব’ এমন মানসিকতা থাকা উচিত নয়। আমাদের অর্থমন্ত্রী হয়তো এ কারণেই বলেছেন, ‘গ্যাসটা এত মূল্যবান সম্পদ যে এটা দিয়ে ডাল-ভাত-তরকারি রান্নার কোনো মানে হয় না।’ খোদ রান্নার কাজেই ১২% গ্যাস ব্যবহৃত হয়। রান্নার জন্য আরো অনেক বিকল্প শক্তি আছে। এগুলো ব্যবহার করতে হবে। বর্তমান মজুদকৃত গ্যাস ২০৩১ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এ মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই অর্থপূর্ণ খাতে এ সম্পদ ব্যবহার জরুরি। তন্মধ্যে প্রধান খাত হবে শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎ খাত। আমরা যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সঠিক ব্যবহার করতাম তাহলে রামপাল কিংবা রূপপুর নিয়ে এত ভাবতাম না। রান্নার জন্য এলপি গ্যাস ব্যবহার জরুরি। কিন্তু এলপি গ্যাসের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের ভিতরে হতে হবে। গাড়ির জন্য সিএনজি গ্যাস ব্যবহার রোধ করা জরুরি। যারা গাড়ি কিনতে পারে তারা জ্বালানি তেলও কিনতে পারবে। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভ ১৪.১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। দৈনিক প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন হয় গড়ে দুই হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। যেখানে চাহিদা রয়েছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট।

বাংলাদেশ হলো এশিয়ার সপ্তম বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলএনজি আমদানি করা যেতে পারে। গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া জারি রাখাতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস বিতরণের ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যেমন প্রিপেইড মিটার সংযোজন। বিশেষজ্ঞদের মতে গ্যাসের উৎপাদন ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। তারপর এর প্রবাহ কমতে থাকবে। তখন ২০৩১ সাল পর্যন্ত চললেও গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সবসমই পার্থক্য থাকবে।

লেখক : মেজর (অবসরপ্রাপ্ত), বর্তমানে আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেটে উপপরিচালক (প্রশাসন ও হিসাব) হিসেবে কর্মরত আছেন।