রবীন্দ্রনাথ
প্রতিদিনের আদান-প্রদান ও ব্যবধান
দেবে আর নেবে, মিলিবে মেলাবে এ তো রীতিমতো বাস্তববাদী লোকের কথা, হিসাবি লোকের। কথাটা একজন মরমি কবি, বাস্তববাদী ছোটগল্পকার এবং আদর্শবাদী ঔপন্যাসিকের, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এ কথা এদিক-ওদিক সবদিক ভেবে চিন্তে এগুনো লোকের কথা। তাঁর মতো লোকের কথায় আমাদের চোখ ফোটার কথা ছিল, কিন্তু ফোটেনি। বাঙালির জন্য, সেই যে তিনি বলেছিলেন, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি, এই খেদ আমাদের সবার বুকেই কম-বেশি বাজে। তিনি আমাদের কত কীই না জানিয়েছিলেন, যেমন, ‘বাইরের মানুষ সাড়ে তিন হাত কিন্তু ভিতরে সে কত প্রকাণ্ড’। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের শ্রেষ্ঠতার সর্বপ্রধান পরিচয় হচ্ছে এই যে, মানুষ সকলের সঙ্গে মিলিত হতে পারে’। মানবমহিমা নিয়ে তাঁর এমন উক্তি কম নেই। কিন্তু তাতে আমাদের কী লাভ? ‘মানুষের ধর্ম জয় করিবার ধর্ম, হার মানিবার ধর্ম নয়’। কারণ, ‘জন্তুরা পেয়েছে বাসা, মানুষ পেয়েছে পথ’। যে পথের শেষ নাই, কী আছে শেষে তাও জানা নাই। যে পথ চলে সে হারায় না, হারেও না। আমরা পথ নয়, বিপথেই চলি। তাই হেরে যাওয়াই আমাদের নিয়তি। নিজের কাছে নিজের প্রতিনিয়ত এই হেরে যাওয়াটা লজ্জাগ্লানির মধ্যে আমাদের নিমজ্জিত করে দেয়। আমরা হুঁশ হারাই। হুঁশ হারানো লোক কি আর মানুষ থাকে?
আমরা রবীন্দ্রনাথের সব কথা যে বুঝতে পারি, তা তো নয়, বুঝলেই তো মানার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু তাঁর তো কথাই নয়, এত গান আছে, এত ছবি আছে, সেসব রুচিবান মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার কথা ছিল। জীবনের বহু বেদনায় সান্ত্বনা হতে পারতেন তিনি।
নগরের জীবন মানুষকে বিচ্ছিন্ন, একা করে দেয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথে কথা, ‘মানুষ যেখানে সম্পূর্ণ একলা সেইখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন’। সেদিক থেকে তো আমরা একলাও হতে শিখিনি। আমাদের বাংলাদেশের লেখক শহীদুল জহির বলেছিলেন, যে মানুষ নিঃসঙ্গ নয়, সে দুর্ভাগা। এই নিঃসঙ্গতা একটা বিশেষ ধরনের একাকিত্ব। এর ভেতরে এক বিশেষ শক্তি আছে। সেই শক্তিটাই ভেতরের শক্তি, আর তাতেই আমাদের যার যার মুক্তির দিশা থাকে। কিন্তু আমরা সেই শক্তির দেখা পাই না। সময় চলে যায়। কদিন আগে কার যেন লেখায় পড়লাম, ‘সময় চলে যায় না, আমরাই চলে যাই’ (আইনস্টাইনও বোধ করি সময়কে এভাবে দেখেছিলেন।) পড়ে, রিলকের সেই কবিতাটির কথাটি ভাবি যেখানে তিনি বলছেন, যখন আমরা সাজাতে চাই, সব কিছু বারবার ভেঙে পড়ে, কিন্তু যখন আমরা সাজিয়ে উঠি, তখন আমরাই ভেঙে পড়ি। এভাবে নানাজনের কথার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা মিলিয়ে দেখা দরকার যে, জীবনের প্রতিদিনের সত্যগুলো সেখানে মিলে কি না। ভারতের আরেক সাধক কবি রজ্জব বলেছিলেন, যে সত্য সর্ব সত্যে মিলে, তা-ই আসলে সত্য। রবীন্দ্রনাথের বহু কথাই জগতে আরো আরো ভাবুক, চিন্তক ও কবি-লেখকের সঙ্গে যদি মিলিয়ে দেখা যেত, তাহলে হয়তো আমরা তার কথা কিছুটা হলেও শুনতাম। কারণ তিনি তো আমাদের ভেতরের লোক, নিজেদের লোক, নিজেদের লোকের কথা না-শোনাই আমাদের বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমরা অন্য লোকের কথাও নিজেদের করে নিতে পারি না। ফলে আমাদের আদান-প্রদানের কাজটা হয় না। ফলে বাইরের লোকের সঙ্গে আমাদের যেমন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও আমাদের ব্যবধান প্রকট।
কবীর সুমন গেয়েছিলেন, ‘প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবিঠাকুর মূর্তি গড়া’। আদতে আমরা যেমন মন দিয়ে তাঁর লেখা পড়ি না, চোখ বুলিয়ে যাই; গানটাও প্রাণ দিয়ে গাই না, গাই গলা দিয়ে। সেই গান নাভী, যা কিনা আমাদের জীবনীশক্তির কেন্দ্র, সেখান থেকে যা উঠে আসে না, সেই গান আমাদের কাজেও আসে না। ফলে রবীন্দ্রচর্চা করা লোকজনের নীচতা-হীনতা-দীনতা আমাদের বিস্মিত করলেও তার বাস্তবতা এ-ই।
আরো একটি কথা, রবীন্দ্রনাথ যতই মরমি, আধ্যাত্মিক লোক হন, তাঁর কথার পরতে পরতে যুক্তির লীলা। তিনি বলেন, ‘আর্টিস্ট অলুব্ধ’। মানে লোভহীন আসক্তিহীন, কিন্তু আমরা দেখি আর্টিস্ট মানেই প্রলুব্ধ, তাঁদের লোভের সীমা নেই, বিশেষ করে অর্থের ও খ্যাতির। (এককালে সতীদাহ প্রথা ছিল, সেটা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, একালের আইন করে ‘খ্যাতিদাহ প্রথা’ চালু করা বড়ই জরুরি হয়ে পড়েছে। দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের কথায়, আমরা বর্তমানে, ‘খ্যাতির ক্রীতদাস, বিকৃত দাস আমরা সবাই’।) কিন্তু আমরা সবাই জানি কাজ চলতে তো হবে। তাই প্রলুব্ধ আর্টিস্টকে দিয়ে এটা করাও সেটা করাও। তাতে আর্টের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হোক, মানুষ সরে যেতে থাক মানুষ হওয়ার পথ থেকে, যেটা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জন্তুরা পেয়েছে বাসা, মানুষ পেয়েছে পথ’, কী সেই পথ, তা গভীরভাবে ভাবার কথা ছিল, আমরা সেটা হালকাভাবেও ভাবিনি, তাই আমরা বাসায় থাকা জন্তু এক একজন; পথচলা মানুষ হতে পারিনি। সেই পথচলা প্রতিদিনের হওয়ার কথা ছিল। আমরা প্রতিদিন কেবল নিজেকে ও অন্যকে থামিয়ে দেওয়ার কাজই করি। তাই এত এত রবীন্দ্রস্তুতি করেও আমাদের সঙ্গে তাঁর কোনো আদান-প্রদান তৈরি হয় না। ব্যবধানটাই কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথ আজও চলমান, আর আমরা থেমেই আছি।