স্মরণ

আমাদের মা, আমাদের স্বাধীনতা

Looks like you've blocked notifications!

আমার মায়েরও সুন্দর একটা সংসার ছিল। বাবার স্বল্প আয়, মফস্বল শহরের ঘনঘন বদলির চাকরি। অনেকগুলো সন্তান, দশ-দশটি সন্তানের দেখাশোনা, যত্ন নেওয়া, বেশির ভাগ সময় কোলে একজন কয়েক মাসের শিশু। বাড়িঘর গোছানো, কোথাও ময়লা জমে নেই, দেয়ালের কোনো কোণায় মাকড়সার জাল ঝুলে নেই, ঝকঝকে মেঝে। টেবিলের ওপর হাতে বোনা এমব্রয়ডারি করা টেবিল ক্লথ। রান্নাঘরে গ্লাক্সো, হরলিক্সের খালি কৌটায় রান্নার মসলাপাতি। প্রতিটি কৌটায় চমৎকার করে লেখা, ‘চিনি’, ‘চা’, ‘জিরা’....। কোনো কৌটার মুখ খোলা নেই, কোনোটার ঢাকনা হারিয়ে যায়নি। মিটসেফের আংটাগুলো থেকে ঝুলছে ঝকঝকে চায়ের কাপগুলো, তার নিচে পিরিচ। এক পাশে আচারের বৈয়ামগুলোয় হরেক রকমের আচার। রান্নাঘরের এক কোণে ছোট মুষ্টিচালের টিন। বাবার অফিসে যাওয়ার আগেই গরম ভাত তরকারি রেডি। ছেলেমেয়েদের গোসল করিয়ে, চুল আঁচড়িয়ে দিয়ে, কালো টিপ পরিয়ে দেবেন, যেগুলোর স্কুলে যাওয়ার বয়স সেগুলোকে স্কুলে পাঠাবেন। দুপুরে বাবার ঘুমের অভ্যাস। ছোট বাচ্চাগুলোকে তার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে, যেন বাবার ঘুমের ব্যাঘাত না হয়! স্কুল থেকে ফিরলেই মেয়েদের খাইয়ে দিয়ে, বিকেলের স্বল্প অবসরে মাথায় তেল দিয়ে, দুপাশে দুটি চুলের বেণী করে দিয়ে বলতেন, ‘যা তোরা খেল গিয়ে’।

তখন বাজারে ফ্রিজ এসেছে কি না জানি না, আমাদের ছিল না। গরমের সময় মাঝে মাঝে বাবা আস্ত তরমুজ কিনে আনতেন। সেই তরমুজ সারা দিন রেখে দেওয়া হতো পানির চৌবাচ্চায়। তখন মফস্বল শহরে গোসলখানায় ইট-সিমেন্টের তৈরি পানির চৌবাচ্চা থাকত। আমরা বলতাম ‘পানির হাউস’। পানি তোলার লোক এসে প্রতিদিন টিউবঅয়েল থেকে পানি এনে ওই হাউস ভরে দিত। টিউবঅয়েলের বরফশীতল পানিতে ভরা হাউস রাখার কারণে তরমুজটি ঠান্ডা থাকত। বাবা ঘুম থেকে ওঠার পর, পড়ন্ত বিকেলে মা বঁটি দিয়ে তরমুজটি কাটছেন, বাবাসহ আমরা মাকে ঘিরে গোল হয়ে বসে আছি। তরমুজের প্রথম ফালি বাবাকে দিয়ে মা দিতেন তাঁর সন্তানদের। আহারে! কি যে মজা লাগত খেতে! তরমুজের ফালির ওপরের লাল অংশ খাওয়া হয়ে গেলে নিচের সাদা অংশে মা লবণ ছিটিয়ে দিতেন আর বলতেন ‘খাও সোনামানিকরা, কামড়িয়ে কামড়িয়ে খাও, এগুলোতে অনেক ভিটামিন আছে।’ ঈদ এলেই বাসায় অন্য রকম পরিবেশ। মাকে মনে হতো সবচেয়ে বেশি খুশি। কত কাজ তার! ছেলেমেয়েরা নতুন নতুন জামাকাপড় পরবে, সেই জামাকাপড় আবার নিজ হাতে রাত জেগে মেশিনে সেলাই করতে হবে। ঈদের সকালে যখন বাবার সঙ্গে ছেলেগুলো নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, মা ব্যস্ত ঈদের সকালের মুগের ডালের খিচুড়ি, ভুনা কলিজা, সেমাই রান্নাতে, আর ছেলেমেয়েদের তৈরি করে দেওয়ার কাজে। নামাজ থেকে এসেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল বাবা আর মাকে সালাম করা। এর মধ্যেই মা গোসল সেরে নতুন শাড়ি পরে আছেন, চুল আঁচড়েছেন কিন্তু ভেজা চুল দিয়ে তখনো টপ টপ করে পানি পড়ছে। বাবাকে সালাম করে মাকে সালাম করি, মা নিচু হয়ে বুকে চেপে ধরেন। আলতো করে কপালে ছোট একটা চুমু দিয়ে বলেন, ‘আমার সোনামণিকে আল্লাহ অনেক হায়াত দাও।’ মায়ের বুকের ভেতর থেকে সরতে ইচ্ছে হয় না। সদ্য গোসল করে এসেছেন, ঠান্ডা শরীর, মুখে পন্ডস ক্রিম, গায়ে ট্যালকম পাউডার, নতুন শাড়ির গন্ধ- সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ যে গন্ধের জন্ম এই পৃথিবীতে না। সারা দিন পর রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে ছোট তিনটিকে বুকের কাছে নিয়ে মা গান গাইতেন, প্রতিমা, সন্ধ্যা অথবা জগন্ময় মিত্রের গান, খুব চমৎকার গানের গলা ছিল আমাদের মায়ের!

মাঝে মাঝে মাগরিবের নামাজ পড়েই বাবার সঙ্গে সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখা। বাসায় ফিরেও গুনগুন গান, শুয়ে শুয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আর স্বপ্ন! অনেক কষ্টে মাটির ব্যাংকে, এখানে ওখানে সিকি, আধুলি আর নোট জমিয়ে, যশোর শহরে ছোট্ট একটি জমি কেনা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে জমাজমি আছে, ওগুলো গ্রামের চাচা ভোগ করেন। গ্রামে যাওয়ার মায়ের একেবারেই ইচ্ছে নেই। সারা জীবন মফস্বল শহরে শহরেই কেটেছে। গ্রামে যাওয়ার কথা মা চিন্তাও করেন না কখনো। বড় ছেলে দেশের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সংসারে একটু সচ্ছলতা এলেই যশোরের জমিটার ওপরে একটা ছোট্ট বাড়ি করবেন। এই বদলির ঝামেলা, দুই-তিন বছর পর পরই জিনিসপত্র বাধা, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়া আর ভালো লাগে না! যশোরে বাড়িটা করতে পারলে আর ঝামেলা পোহাতে হবে না। নিজের বাড়ি মনের মতো করে সাজাবেন! স্বপ্ন দেখেন মা!

এলো ১৯৭১। আমরা তখন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়। সৈয়দপুর, পাকশী, ভেড়ামারা এসব জায়গায় সব সময়ই বিহারিদেরর আধিক্য। মার্চ মাসের শেষ, পাকিস্তানি মিলিটারি নির্বিচারে মানুষ মেরে যাচ্ছে, শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলছে। এপ্রিলের প্রথম, তখনো ভেড়ামারা, কুষ্টিয়ায় মিলিটারি আসতে পারেনি। পাকশী হার্ডিন্জ ব্রিজের এপারে ইপিআরের বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা আর ওপারে পাকিস্তানিদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। চারিদিকে থমথমে অবস্থা, এরই ভেতর বিহারিদের উল্লাস। একপর্যায়ে ইপিআর আর পাকিস্তানিদের ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। ইপিআর গুলি করতে করতে পিছিয়ে যাচ্ছে, আর চিৎকার করে বলছে ‘আপনারা পালান, মিলিটারি এসে গেছে। আপনারা পালান...’। মুহূর্তের ভেতর বাবা-মা তাঁদের দশটি সন্তান নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, শূন্য হাতে। ওই বিপদসংকুল মূহূর্তেও মা ভুললেন না দরজা-জানালা বন্ধ করতে, প্রয়োজনীয় সব কিছুতে তালা দিতে। তার এত সাধের যত্নে গড়া সংসার যেন থাকে নিরাপদে!

গোলাগুলির বিভীষিকা, আগুন, বিহারিদের লুটতরাজ আর তাণ্ডবের ভেতর দিয়ে প্রাণভয়ে আমরা পালাচ্ছি। উদ্দেশ্য শৈলকুপায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া। ভেড়ামারা থেকে অজানা-অচেনা গ্রাম আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমরা গ্রামের দিকে যাচ্ছি, পথে জনপদ, বাড়িঘর, দোকানপাট দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাথার ওপর দিয়ে গুলি, কামানের উত্তপ্ত আগুনের গোলা ছুটে যাচ্ছে, আমরা এগিয়ে চলেছি। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো গরুর গাড়ি, কখনো ঘোড়ার গাড়ি। রাতে অজানা-অচেনা বাড়িতে আশ্রয়। আর তখনই অল্প কিছু খাওয়া জুটত। একদিন এক অচেনা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি অনেকগুলো পরিবার। ভোরের অন্ধকারেই মিলিটারিরা গ্রামটি ঘিরে ফেলল। সামনে যাকে পাচ্ছে মেরে ফেলছে, নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। আমরা প্রায় ২০০ মানুষ ডোবাজাতীয় নিচু এক জায়গায় লুকিয়ে আছি। চারিদিকে ঘন জঙ্গল, বাঁশের বন। আমরা শুয়ে আছি। আগুনের গোলা মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, গুলির ঠা ঠা শব্দে কান ঝালাপালা, শুকনো বাঁশপাতার ভেতর মিলিটারিদের বুটের মচমচ শব্দ। একপর্যায়ে শুনতে পেলাম আমাদের থেকে অনতিদূরেই এমনই এক ডোবার মতো জায়গায় কিছু লোক প্রাণভয়ে লুকিয়ে ছিল, মিলিটারিরা ব্রাশ ফায়ার করে প্রতিটি মানুষকে মেরে ফেলেছে। এখন আমাদের ডোবার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি বাবার পাশে শুয়ে আছি, প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপছি। বাবা বললেন, ‘আয় বাপ বুকে আয়।’ বাবা আমাকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরার অছিলায় নিজের শরীর দিয়ে আমার ছোট্ট শরীরটা ঢেকে রাখলেন। বাবার বুকের ভেতরে মুখ গুজে দিয়ে, বাবার শরীরের উষ্ণতায় কাঁপুনি কমে গেল। বাবা অনর্গল মৃদু কণ্ঠে দোয়া পড়ে যাচ্ছেন, আমিও বাবার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাচ্ছি। দুজনেই মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। ওই ডোবার ভেতর আমরা একটানা চারদিন লুকিয়ে ছিলাম। অনেক কষ্টে, প্রায় ২০ দিন পর কাঙ্ক্ষিত নিরাপদ আশ্রয় আমাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম। মা বা আমরা কেউ কখনো গ্রামে থাকিনি। আমাদের সমস্ত জমাজমি গ্রামের চাচা ভোগ করতেন। আমাদের গ্রামে আসাটা চাচা পছন্দ করলেন না। যাইহোক তবুও প্রাণে বেঁচে আছি, এতেই সবাই খুশি। মা সান্ত্বনা দেন, ‘যুদ্ধ শেষ হবে, দেশ স্বাধীন হবে, বাবা চাকরিতে যোগ দেবেন, আমরা আবার আমাদের বাসায় ফেরত যাব’। ‘কয়েকটা দিন কষ্ট করো, সোনামানিক রা’! আমরা আশায় বুক বাঁধি, দেশ কবে স্বাধীন হবে?’

জুন মাসের দিকে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মহকুমা, থানা, গ্রাম কোথাও কোনো ডাক্তার নেই। বাজারের ওষুধের দোকানসহ সব ধরনের দোকানপাট পাকিস্তানিরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। মহকুমার হসপিটাল, ক্লিনিক পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকায়, এমনকি বড় কোনো জেলা শহরে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য, উপায়, সঙ্গতি কোনোটাই নেই। আমরা জানি না, বাবার কী হয়েছে! গ্রামের হোমিওপ্যাথিক কেশব ডাক্তার আসেন, চার পুরিয়া ওষুধ দেন। বাবাকে খাওয়ানো হয়, বাবার কোনো উন্নতি হয় না। অবস্থা ক্রমাবনতি হতে হতে বাবা শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। আমরা অসহায়ভাবে বাবার ক্রমাবনতি দেখতে লাগলাম। বাবার কষ্টে মা যন্ত্রণায় ছটফট করে বেড়াচ্ছেন। সারা দিন, সারা রাত মা বাবার পাশে জায়নামাজে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছেন। একমুহূর্ত বাবার কাছ থেকে সরেন না, মা খাওয়া ভুলে গেলেন, নাওয়া ভুলে গেলেন। ঘুমাতে যান না, যদি বাবার কিছু প্রয়োজন হয়, যদি বাবা চোখ খুলে দেখেন মা পাশে নেই! মা বাবার শরীর ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দেন, খাইয়ে দেন। বাবা এখন ছোট শিশু, পুরোপুরি অচল, সবকিছু তাকে বিছানাতেই করতে হচ্ছে। মা নিজ হাতে বাবাকে পরিষ্কার করে দেন, গোসল করিয়ে চুল আঁচড়ে দেন। বাবার অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে লাগল, শেষপর্যায়ে গভীর অচৈতন্যতায় চলে গেলেন। দুই-তিনদিন গভীর অচেতনতায় থেকে আমাদের মাকে এক অনিশ্চিত, সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় রেখে, যুদ্ধের মধ্য অবস্থায়, এক বৈরী পরিবেশে, দশ-দশটা বিভিন্ন বয়সের সন্তান রেখে বাবা মারা গেলেন! সবার বড় ছেলেটি তখনো সবে তরুণ, কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে। সবার ছোটটি এক বছরের কাছাকাছি।

বাবা মারা যাওয়ার চার বছর পর বড় ভাই বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করেন, আর সঙ্গে সঙ্গে চাকরিও পেয়ে যান। পরিবারের বিশাল বোঝা নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। আমাদের বড় ভাইকে আমরা দাদা বলি। বিভিন্ন বইতে, গল্পে, উপন্যাসে এ ধরনের দায়িত্ববান বড় ভাইকে ‘পিতৃতুল্য’, ‘দেবতুল্য’, ‘ফেরেশতা-সম’ ইত্যাদি বহু ধরনের বিশেষণে অলঙ্কারিত করা হয়। এই ধরনের বিশেষণ ব্যবহার শুধু গল্প-উপন্যাসের বাক্যলংকরি শব্দই বৃদ্ধি করে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির তুলনা করে ব্যক্তির হৃদয় নিংড়ানো, ঘামঝরানো অবদান প্রকাশ করা সম্ভব না! বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা বা সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা ব্যাকরণগত শব্দচয়ন দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, করা উচিত না। আল্লাহ তো আমার মায়ের কঠিন দুঃসময় আর নিকষ কালো অন্ধকার পৃথিবীর কথা জানতেন, তাই আগে থেকেই উনি আমার মা আর আমাদের জন্য আমাদের দাদাকে প্রস্তুত রেখেছিলেন Celestial Being হিসেবে! আমি নিশ্চিত, আল্লাহ না করুন, (আল্লাহ যেন আমার দাদাকে, আমাদের সব ভাইবোনদের আয়ু দান করে দীর্ঘজীবী রাখেন) যদি কখনো আমার দাদার হার্টের প্রয়োজন হয়, আমাদের ভাইবোনদের ভেতর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে, কে তার হার্টটা আমাদের দাদাকে দেবে! আমাদের দাদার প্রভা-তে, আর মায়ের প্রচেষ্টায় আজ আমরা যে যেখানে যেমনই আছি, সুন্দরভাবে বেঁচে আছি।

জীবন থেমে থাকে না। আমাদের জীবনও থেমে থাকেনি। আমাদের জীবনের চালিকাশক্তি ছিল আমাদের মা। তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে, সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমাদের জীবনকে সামনে নিয়ে গেছেন। উনি ওনার নিজের সার্বভৌম সংসারে আর কখনোই ফিরে যেতে পারেননি। এমনকি এক পলক দেখতেও পাননি তাঁর সেই যত্নের সংসার। আমার মায়ের জীবন ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্টই থেমে গেছে। আগস্টের ১৪ তারিখ, কাকডাকা ভোর, চারিদিকে তখনো হালকা অন্ধকার। বাবার শেষ সময়। গত রাত থেকেই বাবার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দুদিন ধরে উনি সম্পূর্ণ অচেতনতার ভেতর চলে গেছেন। ফুসফুস প্রতিটি নিশ্বাস নিচ্ছে মিনিট ধরে, ফুসফুসের বাতাসের অভাবের যন্ত্রণার শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি। আমরা সবাই তার চারিদিকে বসে আছি। আমরা বুঝতে পারছি তিনি চলে যাচ্ছেন। একজন মানুষ, যিনি আমাদের বাবা, আমার মায়ের সারা জীবনের সঙ্গী, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, সবাই তার মাথার কাছে বসে অসহায়ের মতো তার চলে যাওয়ার প্রতিটা সেকেন্ড দেখতে পাচ্ছি। ফুপু কোরআন তিলাওয়াত করছেন, ‘ইয়া-সিন অল কুরআনিল হাকিম....’। আমরা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছি। মায়ের উন্মত্ত চেহারার দিকে তাকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। মা-বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে উদভ্রান্তের মতো কেঁদে যাচ্ছেন, ‘শোন, তুমি আমাকে, আমার বাচ্চাদের কার কাছে রেখে যাচ্ছো।’ ‘শোন, তুমি আমাদের কোথায় রেখে যাচ্ছো?’ ‘এই, শোনো...’। আমার মায়ের বুকফাটা আকুতি বাবা শুনতে পাচ্ছিলেন কি না জানি না। বাবার শরীর নিথর, চোখ দুটি বন্ধ, কিন্তু দুই চোখের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। বাবা চলে গেলেন! মা শূন্যের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘আল্লাগো, এখন আমি কোথায় যাব, এই দুধের বাচ্চাদের কীভাবে বাঁচাব?’

দেশ স্বাধীন হলো। সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতা পেল, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেল। আর আমার মা নিজের ভুবন, নিজের সংসার হারিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর বাচ্চাদের স্বাবলম্বী করার কঠিন সংগ্রামে। পাশে পেলেন তাঁর আদরের বড় ছেলেকে। মায়ের সেই হাসি-খুশিমাখা, প্রাণোচ্ছলে ভরা চেহারা আর কখনো দেখিনি, আমার মা আর কখনো স্বপ্ন দেখেননি যশোর শহরে নিজের সেই বাড়ির।

শ্রদ্ধেয় কবি শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে ওনাকে অনুরোধ করে একটা চিঠি লিখতাম। বলতাম,

প্রিয় কবি,

আপনি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? দয়া করে নিচের লাইন তিনটি আপনি কি আপনার বিখ্যাত ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার কোনো এক জায়গায় ঢুকিয়ে দিতে পারবেন, অথবা সংযোজন?

‘স্বাধীনতা তুমি সধবা নারীর স্বামী হারানোর নিঃশব্দ আর্তচিৎকার,

স্বাধীনতা তুমি স্বাধীন নারীর স্বপ্নভাঙা আমৃত্যু পরাধীনতা,

স্বাধীনতা তুমি অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুমরে মরা একটি মায়ের লাশ।’

লেখক : প্রবাসী লেখক, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া