স্বজনপ্রীতি আর দলীয়করণের ভূত কি তাতে নামবে!
গণমাধ্যমের খবরে জানলাম, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার বিধানের কথা বলা হয়েছে। এখন কেবল মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে এই মৌখিক পরীক্ষার বিষয়টি অনেকটাই লোক দেখানো। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়ার বিধানটাই স্বীকৃত। এই দুই পরীক্ষায় পিছিয়ে থেকে, মৌখিক পরীক্ষায় অনেক ভালো করেও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই। তবে বিকল্প আর একটি উপায় অবশ্য আছে, তা হচ্ছে, কোন প্রার্থীর কতটা প্রভাব! তা নিয়ে রীতিমতো একধরনের প্রতিযোগিতা চলে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ঢালাওভাবে বললাম। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কি এমনটাই হচ্ছে না?
কিন্তু এ ক্ষেত্রে হঠাৎ করে লিখিত পরীক্ষার বিষয়টি কেন আসছে? কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে, ‘অনিয়ম এড়ানো’। এ ছাড়া সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ‘অপরাধীদের’ নিয়োগ ঠেকানোও নাকি একটি বড় উদ্দেশ্য। এ জন্য নিয়োগ দেওয়ার আগে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নাকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসিকে এসব নির্দেশনা দিয়েছে।
দেশে বর্তমানে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে ৩৭টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনা অনুসরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তা মন্ত্রণালয়কে জানাতে ইউজিসিকে অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত, ফলে সরকারে নির্দেশনা তারা কতটা মানবে সেই প্রশ্ন থেকে যায়। তবে যদি সরকার ‘রাজনৈতিকভাবে’ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে স্বায়ত্তশাসিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তা না মেনে কি কোনো উপায় থাকবে? ফলে ধরেই নিলাম, হয়তো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ওপরের নির্দেশনা বাস্তবে রূপ পেলেও পেতে পারে।
ওপরের নির্দেশনা মেনে নিলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি এখন অনেকটাই ‘পাবলিক’। তার ওপর সরকার চায় না, এমন লোকও ফাঁক দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের ঠেকানো এই নির্দেশনার একটি লক্ষ। দেশবিরোধী কোনো লোক কোথাও জায়গা পাবে না, এটাই আমার মত। কোনো মানুষের ব্যক্তিজীবনের সর্বোচ্চ পড়াশোনার স্থান বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে যাঁরা পড়বেন এবং পড়াবেন, তাঁদের মান হতে হবে তেমনি সর্বোচ্চ। দেশের প্রেক্ষিতে একটা সময় হয়তো তাই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিল। দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম সূতিকাগার হয়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয় বিলিয়েছে জ্ঞান আর ঐতিহ্যের সৌরভ। ওপরের কয়েকটি লাইনে হয়তো অনেকে ‘অতীত’-এর গন্ধ পাচ্ছেন। গৌরবের অনেক কিছুই কি এখন অতীত নয়? কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সার্বিকভাবে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এখন চলে আসছে সামনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, ভালো ফল করেছি। শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় অংশও নিয়েছি। সেই সঙ্গে সাংবাদিকতার সঙ্গে অনেকদিন যুক্ত থাকায় চোখের সামনে দেখেছি অনেক কিছুই। সেই দেখা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার। যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ না দেওয়া বলে নানা বিচারে ‘বাছাই’ কিংবা ‘মনোনয়ন’ দেওয়া বলাই ভালো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোক দেখানো মৌখিক পরীক্ষার নামে, ‘স্বজনপ্রীতি’ আর ‘দলীয়করণে’র চর্চা করা হয়। আর এভাবে মেধার বদলে জায়গা পেয়ে যাচ্ছে অযোগ্য একটা শ্রেণি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই বীজ বোপিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতেই। প্রথম শ্রেণি পাইয়ে দেওয়া কিংবা পাওয়ার চেষ্টায় কত কিছুই না হয়ে যায়। এভাবে অনেকে ভালো ফলাফলের মুখ দেখে। পরে তারাই এগিয়ে যায় শিক্ষক হওয়ার দৌড়ে। কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। সেগুলো উদাহরণ নয়।
কিন্তু একটা সময় এই অবস্থা ছিল না। অনেক গুণী মানুষ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে এই পেশাকে আলোকিত করেছেন। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের অনেকে এখনো বর্তমান। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান আর কৃতজ্ঞতার কোনো কমতি নেই। কিন্তু এখন কি হচ্ছে! ছাত্র-শিক্ষকরা ‘অনুগত’ দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। তাঁদের বড় একটি অংশ যেভাবে পদ-পদবি আর সুবিধা পাওয়ার আশায় লেজুড়বৃত্তি করছেন, তাতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া কী, তা নিয়ে কি আর কাউকে বলে দিতে হবে! এটি সব সরকারের আমলেরই ঘটনা। আর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কেবল রাজনৈতিক প্রভাব নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য ধরনের অনিয়মও কাজ করে। ফলে শিক্ষক নামে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারা জায়গা পাচ্ছে, বোধ করি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা সেটা টেরও পাচ্ছে। আবারও বলছি, ব্যতিক্রম কোনো উদাহরণ নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লিখিত পরীক্ষার নিয়ম করেও কি অনিয়ম, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ঠেকানো যাবে! বিসিএস ও অন্যান্য পরীক্ষার উদাহরণ কি আমাদের সামনে নেই। আর লিখিত পরীক্ষার খাতা তো তারাই দেখবেন, যারা নিয়োগ দেন। নাকি অন্য কোনো উপায়ে সেই খাতা দেখানো হবে? সেখানে ‘দুর্নীতি’ নামক অন্য কোনো কিছু নতুনভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কলুষিত করবে না তো! তা ছাড়া বলা হচ্ছে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ লাগবে। অর্থাৎ এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের একধরনের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ লাগবে। এতে নতুন সমস্যা দেখা দেবে না তো?
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, এত যে সমালোচনা করছেন, সমাধান কী। সমাধান একটাই- ‘সততা’। নিষ্ঠা আর পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ পর্যায়ে ভালো ছাত্র নির্বাচন করতে হবে। আর সত্যিকার অর্থে পরীক্ষা নেওয়া হলে সেটা মৌখিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেও যোগ্য লোককে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। আর লিখিত পরীক্ষার বিধান করতে চাইলে এখানেও প্রয়োজন সঠিক প্রক্রিয়া ও সদিচ্ছা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচিত ব্যক্তি দেশবিরোধী কিংবা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত কি না, অবশ্যই সেটা ভালোভাবে দেখা দরকার রয়েছে। যেন কোনো অবস্থাতেই ‘ভুল মানুষ’ ঢুকে না পড়ে। ভুল মানুষ ঢুকে পড়লে শিক্ষার্থীরাও ভুল পথে চলে যেতে পারে। কিন্তু আমরা কি পারব এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করতে?
লেখক : হেড অব নিউজ, টিবিএন টোয়েন্টিফোর টেলিভিশন, নিউইয়র্ক