পূজা
শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাষষ্ঠীর আরাধনা
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ফিরে ফিরে আসে প্রতিবছরের শারদীয় পূজা উৎসব। দুর্গা হলো মায়ের প্রতীক। দুর্গতিনাশিনী। দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুভ মহালয়ার মাধ্যম দিয়ে শুরু হয়। তারপরে প্রথমা, দ্বিতীয়া এভাবে পঞ্চমী পর্যন্ত মূর্তি, প্রতিমা তৈরি ও সাজানোর কাজসহ পূজারম্ভ পর্ব চলতে থাকে। আর পূজার মূল পর্ব শুরু হয় ষষ্ঠীর মাধ্যমে। পূজারম্ভের ধারাবাহিকতায় একে মহাষষ্ঠী বলা হয়। এ মহাষষ্ঠীর আগপর্যন্ত পূজার যে প্রস্তুতি চলতে থাকে তার পরিসমাপ্তি হয় ষষ্ঠী শুরুর মাধ্যমে। এভাবে পূজা শুরু হওয়ার পরে সেটি সর্বজনীনতা লাভ করতে থাকে।
বলা হয় সনাতন হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবে সব পূজা-পার্বণের মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে বড় মহাযজ্ঞ। এবারে দুর্গা মা আসবেন ঘোড়ায় চড়ে। আবার কখনো নৌকায় চড়ে আসেন। পৌরাণিক কাহিনীর তথ্যমতে কথিত আছে, যে বার মা দুর্গা নৌকায় চড়ে আসে সেবার বেশি বৃষ্টি হয়। আবার যে বার মা দুর্গা ঘোড়ায় চড়ে আসেন সেবার বৃষ্টি কম হয় এবং গরম বেশি থাকে। এবার ঘোড়ায় চড়ে আসবে বলেই হয়তো এখন বৃষ্টি কম এবং গরম বেশি বলে বলা হচ্ছে ধর্মগুরুদের পক্ষ থেকে।
এ সময় গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লা ও সারা দেশের শহর পর্যায়ে তৈরি হয়েছে হাজারো পূজামণ্ডপ। আমাদের দেশটি মূলত একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে যেমন মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দময় ঈদ উৎসব পালিত হয় সর্বজনীনতায়, তেমনি পালিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী, মহররম মাসে আশুরাসহ অন্যান্য পবিত্র ধর্মানুষ্ঠান ও রীতিনীতি। অপরদিকে একই সাথে কাছাকাছি সময়ে পালিত হয় হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গপূজা। আবার তার মাত্র কয়েকদিন পরই পালিত হয় কালীপূজা। এখন মন্দিরে মন্দিরে প্রতিমা তৈরি শেষ। ২০ আশ্বিন ১৪২৩ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ৭ অক্টোবর ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার ষষ্ঠী। দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় ষষ্ঠীতেই। তবে ষষ্ঠীপূজা অর্থাৎ বোধনের দিন থেকেই পূজা শুরু হলেও পূজার আসল আমেজ মানে ভিড় জমতে শুরু হয় সপ্তমী থেকে। পূজার সময় সবচেয়ে বেশি আনন্দে মেতে উঠে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ান যেকোনো ধর্মের লোকজন। সখ করে অনেকে দেখতে আসেন পূজামণ্ডপগুলো।
টেলিভিশনের সংবাদসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ করে স্টার জলসাসহ ভারতীয় কিছু টিভি চ্যানেলের প্রতিদিনের ধারাবাহিক নাকটগুলোতে এসব পূজার অনুষ্ঠানাদি আগে থেকেই প্রচার পেতে থাকে। সেজন্য আমার বাচ্চা ছেলেদেরও প্রতিবছর ময়মনসিংহ শহরের সব পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। কারণ ইতিমধ্যে আমার ছোট ছেলে বায়না ধরে আমাকে দিয়ে প্রমিজ করিয়ে নিয়েছে যে, তাকে এবারে শহরের সব পূজামণ্ডপ প্রত্যেকদিন দেখানোর জন্য নিয়ে বের হতে হবে। এটাকেই বলে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সার্বজনীনতা ও উদারতা। আর ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’- এ স্লোগানটির যথার্থ সত্যতার প্রমাণ মিলে তখন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা রীতিনীতি এভাবেই চলে আসছে। আগেই বলেছি এবার মা দুর্গাদেবী আসছেন ঘোড়ায় চড়ে। প্রতিবারই দেবী মর্ত্যলোকের বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন স্বর্গের শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে। দেবীর সঙ্গে থাকেন তাঁর চার সন্তান। এঁরা হলেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী, কার্তিক ও সিদ্ধিদাতা গণেশ। দেবীকে বরণ করার জন্য সবাই সমানভাবে উদগ্রীব থাকে। ঘরে ঘরে নারিকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া বানাতে ব্যস্ত থাকেন মায়েরা।
নতুন জামা-কাপড় কেনায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন সবাই। আর এসব যে শুধু হিন্দু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়। এগুলো ছড়িয়ে পড়ে সব ধর্ম-বর্ণ ও গ্রোত্রের মানুষের মধ্যে। জগজ্জননী মায়ের আগমনে এভাবেই হয়ে থাকে ‘সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব’। শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে একে শারদীয় দুর্গোৎসব বলা হয়ে থাকে। শরৎকালটি এমনিতেই প্রকৃতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আরামের মৌসুম। বর্ষার প্রায় শেষদিকে এ সময় মাঝেমধ্যে থাকে আকাশে সাদা মেঘের ঘনঘটা। সেই সাদা মেঘের সাথে রং মিলিয়ে মাঠের কাছে বনের ধারে থাকে সাদা সাদা কাশ ফুল। বিকেল কিংবা রাতের প্রকৃতিতে শুরু হয় তখন আগমনী শীতের বার্তা। ঠিক এমন একটি মুহূর্তেই শুরু হয় শারদীয় সার্বজনীন দুর্গোৎসব। মহাসপ্তমীতে শুরু হয় মূল পূজা। ঢাকঢোলের তালে দেবীপূজার মূলপর্ব শুরু হয় এখান থেকেই। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঢাকের তালে নাচতে নেমে পড়ে সবাই।
আর অষ্টমীর সকালে দেবী পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিতে মহাসপ্তমীর রাতে নানা রকমের ফুল আর বেলপাতা সংগ্রহের কাজ করে কিশোর থেকে যুবক বয়সীরাই। আর অষ্টমীর সকল বেলায় পরিবারের সবাই মিলে পূজামণ্ডপে গিয়ে দেবীর পায়ে মন্ত্র পড়ে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া ছাড়াও কুমারী পূজা দেখতে ভিড় করেন। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া পূজার এ সময়টাতে আর তেমন বিশেষ কাজ থাকে না কিশোর কিংবা যুবক বয়সীদের। চলাফেলা আর পড়াশোনায় বিধিনিষেধ না থাকায় যেন বেশি আনন্দেই মেতে উঠেন সবাই। নবমী পূজার রাতের অনুভূতি থাকে বিসর্জনের বেদনা। পূজা শেষের একটা বেদনা কাজ করে এ রাতে। তবে আরতি আর ঢাকঢোলের তালে সেটা খুব কমই বুঝা যায়।
এবার দেবীর আগমনের মতো গমনও হবে ঘোড়ায় চড়ে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চারদিনের পূজা শেষে দশমীতে হয় মায়ের বিসর্জন। এবার পূজার দশমী হবে ২৪ আশ্বিন মোতাবেক ১১ অক্টোবর। কাজেই দেখা যাচ্ছে মানুষে মানুষে ধর্মে ধর্মে যতই ভেদাভেদ থাকুক না কেন সব ধর্মেরই মূল বাণী হলো আনন্দ, ত্যাগ, বিষাদ ইত্যাদির সমাহার। আর সবচেয়ে বেশি যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো সব ধর্মেরই আরেকটি অন্যতম মূল বাণী হলো মানব প্রেম ও মানব কল্যাণ। সেজন্য এসব ধর্মের নামে আজকের দিনে যে জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে তা আসলে ধর্ম প্রচারের নামে কূপমণ্ডুকতা, ভণ্ডামি- এক কথায় সুবিধাবাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এখানে ঈদের জামাতে, মসজিদে নামাজ আদায়ের সময়, ইসলামী তাজিয়া মিছিলে, পুরোহিতদের পূজা অর্চনাকালে, পণ্ডিতদের জ্ঞান চর্চাকালে, গীর্জার ধর্মযাজকদের, বৌদ্ধ মূর্তি পোড়াতে সব স্থানেই সন্ত্রাসের হাত সম্প্রসারিত। তবে আশার কথা, এখন সরকারের তরফ থেকে এসব অনুষ্ঠানাদি নির্ভয়ে উদযাপনের জন্য ব্যাপক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সবাই যার যার অবস্থানে একটু সচেতন হলেই যেকোনো ধরনের অঘটন মোকাবিলা করা সহজ হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়