সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চায় মুক্ত গণমাধ্যম অপরিহার্য

Looks like you've blocked notifications!

পারিপার্শ্বিক জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানার অনিঃশেষ আগ্রহ আর স্বাধীনতা নিয়েই দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ। এটি জন্মগত স্বাধিকার। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ চিন্তা-চেতনা ও বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগের অবাধ স্বাধীনতায় অভ্যস্ত। তবে জানার এই অসীম যোগ্যতা থাকলেও যুগে যুগে মানুষ জানতে ও জানাতে গিয়ে নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা কখনো কখনো শাসকগোষ্ঠী অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে। সত্য কথা বলার দায়ে বহু গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা কঠোর শাস্তিরও সম্মুখীন হয়েছেন; কিন্তু জানা ও জানানোর ইচ্ছা ও চেষ্টাকে কেউ কোনোদিন অবদমন করতে পারেনি। জানার স্বাধীনতা মানুষের এমন এক স্বাধীনতা যা দমন করা যায়ও না। এরপরও স্বাভাবিক এ প্রবৃত্তিকে রুখে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টায় নিয়োজিত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার। তারা তাদের ‘বিতর্কমুক্ত’নিয়মিত কার্যপ্রবাহ ও বেপরোয়া আচরণের ন্যূনতম সমালোচনা শুনতেও নারাজ। অ্যারিস্টটলের বিখ্যাত সেই উক্তিই মনে হচ্ছে বারবার- ‘আইন যেখানে শাসন করে না সেখানে কোন শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে না’।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা কিংবা সাংগঠনিক কার্যক্রমের চেয়ে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকারের দায়িত্বশীলদের বেশি ব্যস্ততা লক্ষণীয়। সেন্সরশিপ সমাজের মধ্যকার বিদ্যমান বিশ্বাসহীনতারই প্রতিফলন নিঃসন্দেহে। আর এটা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও মিডিয়ার সমালোচনা করেন। টেলিভিশন টকশোতে যারা সরকারের সমালোচনা করেন, তাদের ব্যাপারে বেশ তির্যক মন্তব্য করেছেন তিনি। তবে সব টকশোতে অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয় কি? বিভিন্ন সময়ে টকশোগুলো থেকে নির্ধারিত আলোচকদের বাদ দেওয়ার খবরও শোনা গেছে।

সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগে। চ্যানেল ওয়ান টেলিভিশনও বন্ধ করা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দৈনিক বাংলা, টাইমস, বিচিত্রা, আনন্দ বিচিত্রাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন অনেক সাংবাদিকই চাকরি হারান।

সাংবাদিক সাগর-রুনির নির্মম হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো উদঘাটিত হয়নি। এই ব্যর্থতা কার? সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আসলে কতটুকু?

জনসমর্থনে গঠিত সরকারের পক্ষে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে না। যারা জনসমর্থনহীন, কর্তৃত্ববাদী ও একনায়কতান্ত্রিক, তাদেরই বিকল্প হিসেবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ভাবতে হয়। আইনের শাসনের তোয়াক্কা করতে হয় না। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক। গণতন্ত্র না থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না, তেমনই মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সংকুচিত হয়ে যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তাহলে সেটি একটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের মনে রাখা উচিত, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতার দীর্ঘস্থায়ীকরণ করা যায় না। ইতিহাস এর স্বাক্ষী, অতীত এর প্রমাণ। অতীত ঘটনা ও ইতিহাসের সত্যকে বিবেচনায় রেখে শাসকগোষ্ঠীর এ নির্মম পথ থেকে ফিরে আসা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগজনক বাস্তবতা, অতীত কেউ মনে রাখতে চায় না। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষাগ্রহণও করে না।

লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়