নেপালের দিনলিপি-৩

ধন্য হিমালয় কন্যা

Looks like you've blocked notifications!
ভূমিকম্পে কাঠমান্ডুর বসন্তপুর দরবার স্কয়ারের ধ্বংসস্তূপ। ছবি : লেখক

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস যেন এক ছোট্ট বাংলাদেশ। ২৫ এপ্রিলের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর থেকেই বাংলাদেশ দূতাবাস হয়ে ওঠে নেপালে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সবচেয়ে ভরসার জায়গা। যদিও ভূমিকম্পের আতঙ্কে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বারবার নেমে আসছিলেন দূতাবাস ভবনের সামনের লনে। একপর্যায়ে লনেই বেশ কয়েকটি অস্থায়ী ক্যাম্পিং তাঁবু তৈরি করা হয় রাত্রিযাপনের জন্য। প্রথম দিনেই দূতাবাসে আশ্রয় নেন প্রায় ৭০ বাংলাদেশি। প্রতিদিনই একদলকে বিমানে করে পাঠানো হয় বাংলাদেশে, আর তাঁদের জায়গা দখল করেন নেপালে অন্যান্য জায়গা থেকে আসা আরো বাংলাদেশি। এভাবে প্রায় পাঁচ দিন অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ দূতাবাস যেন এক মিনি শরণার্থী শিবির। প্রতিদিন তিনবেলা করে এতগুলো মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করা, থাকার ব্যবস্থা করা, এসব কিছু করতে গিয়ে দূতাবাসের কর্তারা যে দায়িত্বশীলতা আর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা রীতিমতো অসাধারণ। নিরলস পরিশ্রম করা প্রশাসনের এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, ইস্! সবাই যদি এমন হতেন তাহলে বাংলাদেশের প্রশাসন হতো পৃথিবীর অন্যতম সেরা।   

সত্যি বলতে কী, নেপালের বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎপরতার কারণেই বাংলাদেশিদের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে ইউনিলিভারের তিন নারী কর্মকর্তা আর সিরাজুল হক সাগর নামের এক বাংলাদেশি ট্রেকারকে খুজেঁ বের করতে কর্মকর্তাদের দৌড়ঝাঁপ আর ঘুমহীন, ক্লান্তিহীন তৎপরতা যেকোনো পর্যায়েই প্রশংসার দাবি রাখে।

বাংলাদেশ দূতাবাসের কথা যখন এলো তখন বলে রাখি, নেপালকে সহায়তা করতে বাংলাদেশ সরকারও বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম কাজ শুরু করে কাঠমান্ডুর ২০ কিলোমিটার দূরে ললিতপুরে। বাংলাদেশই প্রথম দেশ যারা মেডিকেল টিম পাঠিয়েছে নেপালে আর্তমানবতার সেবায়। আর সেখানেই পরিচয় হয় আকৃতি কৈরালা নামের এক ২১ বছর বয়সী নেপালি মেয়ের সঙ্গে।

পেশায় নার্স এই মেয়ে পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশেই। তাই তিনি যখন রেডিওতে খবর শুনতে পান যে বাংলাদেশের মেডিকেল টিম ললিতপুরে আছে, তখনই তিনি আরো দুজন বন্ধুকে নিয়ে চলে যান ক্যাম্পে বাংলাদেশ দলকে সহায়তা করতে।

বন্ধুত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আর বন্ধুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার অদ্ভূত সেই আবেগ মুগ্ধ করে দেয় আমাদের। এই ফাকেঁ জানিয়ে রাখি প্রতিবছর নেপাল থেকে প্রায় হাজার খানেক ছেলেমেয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে পড়তে আসে। এরাই আবার নেপালে ফিরে গিয়ে সুনাম বাড়ায় বাংলাদেশের। কথা প্রসঙ্গে জানলাম গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে পাস করা ডাক্তাররা নেপালেও বাংলাদেশি কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করছেন। ফলে নেপালের বাজারে বেশ ভালো অবস্থান তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধের।

২৯ তারিখ সকালে আমি গেলাম কাঠমান্ডু শহরের প্রাণকেন্দ্র বসন্তপুর দরবার স্কয়ারে। হাজার বছরের পুরনো এ দরবার স্কয়ারের মাত্র তিনটি ভবন কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে অসংখ্য ফাটল নিয়ে। একে তো কিছুক্ষণ পর পরই ভূমিকম্প সেই সঙ্গে বৃষ্টি, সব মিলিয়ে আবারও ভূমিধ্বস আর ভবন ধ্বস।

বসন্তপুর দরবার দেখে খারাপই লাগল। হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য সব দেড় মিনিটের ব্যবধানে ধুলায় মিশে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা ইট কাঠ আলাদা করে রাখছেন বটে, কিন্তু তাঁরা এটাও জানেন, এ দরবার স্কয়ার কখনোই আর তার পুরনো চেহারা ফিরে পাবে না, ফেরানো সম্ভব না। তারপরও কত যত্নে একটি একটি পাথর, কাঠের টুকরা কিংবা টেরাকোটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা।

একই অবস্থা ধারাহারা টাওয়ারেরও। কি ছিল আর কি হয়ে গেল। দেখে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করার নেই। সেখানেও চলছে উদ্ধার তৎপরতা, আর পথের কুকুরগুলো লাশ পচা গন্ধে খাবারের সন্ধানে খুঁজে বেড়াচ্ছে পুরো ধ্বংসস্তূপ। সে এক ভয়ঙ্কর মন খারাপ করা দৃশ্য।

দুই জায়গাতেই দেখলাম অনেক নেপালি দেখতে এসেছেন তাঁদের প্রিয় ঐতিহ্যকে। এ দরবার বা টাওয়ারের ইতিহাস বলাই হয়তো কারো পেশা ছিল, সেই পেশা তো আর থাকলই না, উল্টো অনেকেরই বাস্তুভিটা নিয়ে চলছে সংগ্রাম। পুরো শহরের মানুষ আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন রাস্তায় রাস্তায়। যাদের গাড়ি রয়েছে তারা ঘুমাচ্ছেন গাড়িতে খোলা রাস্তার ধারে। আর যাদের গাড়ি নেই তাঁরা কোনোমতে চাদর বা ত্রিপল টানিয়ে পার করছেন একেকটি রাত। প্রকৃতির কী নির্মম খেলা!নিজের ঘরের সামনেই বাস্তহারা সব মানুষ। কোনো খাবার নেই, পান করার জন্য পানি নেই পর্যাপ্ত। নেই ব্যবহার করার মতো শৌচাগার। সবই মাত্র দেড় মিনিটের ধ্বংসযজ্ঞের ফল।

পরের দিন ৩০ এপ্রিল গেলাম আরেক দরবারে। এবারেরটা কাঠমান্ডু শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ভক্তপুরে। পর্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত এ দরবার তার অনন্য মিউজিয়ামের জন্য। সেখানেও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। স্থানীয় মানুষজন রীতিমতো শরণার্থীদের মতো খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন হতবাক হয়ে। বাচ্চারা খেলতে ভুলে গেছে। চুপচাপ পানির বোতল হাতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে খাবার পানি সংগ্রহ করতে। একদিকে চুলা বানিয়ে বড় বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছে, জাউভাতের মতো মিষ্টি পায়েস আর একপদ সবজি। কিছুক্ষণ পরই দেখলাম সবাই মিলে দুই সারিতে লাইন ধরে বসে পড়ল পাতার থালা হাতে নিয়ে। একেকজনের জন্য বরাদ্দ দুই চামচ পায়েস আর আধা চামচ সবজি। সেই দৃশ্য দেখে আর কার সাধ্য পেট ভরে খাবার। সেদিন রাতে যখন বাংলাদেশ দূতাবাসে রাতের খাবার খেতে বসলাম, বারবার চোখে ভেসে উঠছিল নিষ্পাপ অসহায় মুখগুলো। সে চোখে প্রতিবাদ নেই, জল নেই, চাহিদা নেই, আছে শুধু বেদনা আর বাস্তবতা মেনে নেওয়ার শক্তি।

বোধহয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কোনো কালে, কোনো এক নেপালিকে দেখেই লিখেছিলেন, তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবার দাও শক্তি। আসলেই এমন সর্বংসহা জাত খুব কমই দেখেছি। যারা কষ্টে থেকেও খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করে না। ঘর খোলা রাখলেও চুরি-ডাকাতি হয় না, যারা বারবার মাথা তুলে দাঁড়াতে জানে সীমিত সামর্থ্য দিয়ে হলেও। তুমি ধন্য হে হিমালয়ের কন্যা।।

(চলবে)