অনন্ত বিজয়

আপনার মৃত্যু পথ দেখাবে

Looks like you've blocked notifications!
নাহিদ হাসান নলেজ

সময়টা সম্ভবত ২০০৮ সালের শেষের দিকে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের নিয়মিত পাঠচক্র চালু করেছে রেদোয়ান ফেরদৌস, সায়েম, ফরহাদসহ কয়েকজন। এদের কার্যক্রম দেখা এবং সিলেটের সৌন্দর্য দেখার লোভ - এই দুই কারণে সিলেট যাওয়া পড়ে।

সেখানেই পরিচয় হয় 'যুক্তি' পত্রিকার সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশের সঙ্গে। পরিচয়ের আগেই ঢাকায় আজিজ মার্কেটে ‘যুক্তি'র উদ্বোধনী সংখ্যাটি দেখে ফেলেছি। প্রচ্ছদ দেখেই আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। প্রচ্ছদটি ছিল সক্রেটিস থেকে আরজ আলী মাতুব্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন নিগ্রহের শিকার মহান লেখকদের মুখ দিয়ে। ঠিক বিজ্ঞানচেতনা পরিষদের শুরুর দিকে, ধ্রুব এষের করা একটি পোস্টারের মতো।

অনন্ত বিজয়ের সঙ্গে আমার আলোচনার বিষয়ই ছিল 'বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনে'র জনবিচ্ছিন্নতা বিষয়ে। আমার দিক থেকে বক্তব্য ছিল এ রকম, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী চর্চা শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের সেবা করে। যেহেতু ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশে ও পৃথিবীতে পুঁজিবাদ কায়েম আছে, সেহেতু এই ধরনের চর্চায় তার প্রতিফলন থাকবে। তখন বিজয় রাশিয়ার একটি ঘটনার উদাহরণ টেনে আনলে বলি- যেহেতু পুঁজিবাদ নিজেই একটি অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা, সেহেতু পুঁজিবাদের অধীনে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিশুদ্ধ যুক্তি চর্চার ফল পুঁজিপতিদের পক্ষে থাকে। আর এখানে উৎপাদন ব্যবস্থা-সম্পর্ক যদি বৈজ্ঞানিক হয়, তাহলে এটার দরকার আছে। তৎকালীন সোভিয়েত ব্যবস্থা যদি বিপ্লবী চরিত্রের হতো, তাহলে এটা ঘটত না।

আলোচনায় মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়া নগরের গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক হাইপেশিয়ার উদাহরণও চলে এসেছিল এই কারণে যে, জ্ঞানচর্চায় যদি জনগণের অংশগ্রহণ ব্যাপক মাত্রায় না থাকে, তাহলে সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ ও জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টরা আমাদেরও একই পরিণতি ঘটাবে।

তারপর আমরা জনবিচ্ছিন্নতা ঘুঁচানোর উপায় নিয়ে কথা বলতে সাম্রাজ্যবাদী উন্নয়ন পরিকল্পনা, যেমন ফুলবাড়ি কয়লা খনি, বিশ্বব্যাংকের পরিকল্পনায় ভারত ও বাংলাদেশ কর্তৃক উজানে পানি আটকানো এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা সৃষ্টিতে কার্যক্রম হাতে নেয়া। এইভাবে যদি আমরা কর্মসূচি হাতে নিই, তাহলে বিজ্ঞানকে আর ল্যাবরেটরির ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর ব্যাপার বলে মনে হবে না জনগণের কাছে। নইলে নিপীড়িত জনগণ উল্টো আমাদের শত্রু মনে করবে। ফলে আমরা কারো উপকার করতে পারব না -না জনগণের না নিজের।

আজ অর্ধ যুগ পরে অনন্ত বিজয় দাশের মৃত্যুতে সেদিনের আলাপচারিতাটুকু মনে পড়ে গেল। নিজের মধ্যে আত্মগ্লানি কাজ করছে, সেই আলাপটুকু পরে এগিয়ে নিলাম না কেন! আরেকবার মনে হয়, তিনি নিশ্চয়ই আরো গণমুখী হয়ে উঠেছিলেন। না হলে স্থানীয় প্রতাপশালী আওয়ামী সাংসদ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপককে চাবুক মারার ইচ্ছা পোষণ করেন প্রকাশ্য মঞ্চে, তখন তিনি তার প্রতিবাদে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন কেন? যাঁর মৃত্যুতে সিলেট শহরে হরতালইবা পালিত হবে কেন? নিশ্চয়ই তিনি দিনের পর দিন বিজ্ঞান ও যুক্তির আন্দোলনকে জনগণের নিকটবর্তী করছিলেন বলে গণশত্রুরা তাঁকে সময় থাকতে সরিয়ে দিল। ইতিহাসের তো এই শিক্ষা -আপনি যত জনগণের নিকটবর্তী হবেন, গণশত্রুরা আপনাকে তত ভয় পাবে।

বিনয়ী ও দৃঢ়চেতা অনন্ত বিজয় দাশ, আপনার মৃত্যু আমাদের পথ দেখাবে।

লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম।

ই মেইল : nahiduttar@yahoo.com