প্রকৃতি

কেমন আছে সুন্দরবন

Looks like you've blocked notifications!
মুশফিক আহমদ

জোয়ার-ভাটায় স্নাত সুন্দরবনের মোট আয়তনের বিশাল অংশজুড়েই রয়েছে জল। ছোটবড় বহু নদী আর খাল জালের মতো জড়িয়ে আছে অপরূপা এই বনকে। শত শত ধরনের মাছ, বন্যপ্রাণী আর কীটপতঙ্গ মিলে এখানে তৈরি হয়েছে জলজ জীববৈচিত্র্য সম্পদের এক বিশাল ভান্ডার। নদী ও খালে আছে লোনাপানির কুমির, ভোঁদড়, শুশুক, চিংড়ি, কাঁকড়া, কাছিম প্রভৃতি। বর্তমানে মহাবিপন্ন লোনাপানির কুমিরের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল এই সুন্দরবন। বাংলাদেশের একমাত্র নদীর শুশুক সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে দেখা যায়। যে নদীতে এই শুশুকগুলোর অবস্থান সবচেয়ে বেশি বলে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছিলেন সেই শ্যালা নদীতে গত বছরের ডিসেম্বরের ৯ তারিখে ঘটে গেল এমন দুর্ঘটনা যা সুন্দরবনের বুকে আগে ঘটেনি। শীতের ভোরে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় দুটি জলযানের সংঘর্ষে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল বহনকারী একটি যান পানিতে ডুবে যায়। ফলে এই বিপুল তেল ছড়িয়ে পড়তে থাকে সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোতে। প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর সুন্দরবনের নদীগুলোর জোয়ারভাটার খেলায় ভাসমান এই তেল ছড়াতে থাকে গহীন থেকে গহীনে। ফলে জীববৈচিত্র্যের কমবেশি যে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা নির্দ্বিধায় সবাই স্বীকার করেছেন। এই মাসেই ঘটে গেল আরেকটি দুর্ঘটনা। এবার বিপুল পরিমাণ সারবাহী জলযান ডুবোচরে আটকে সার গলে পানির সাথে মিশে ক্ষতিগ্রস্ত হলো জলজ প্রতিবেশ।

দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহল থেকে একটি প্রশ্নের উদয় হয়েছে, যে সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা এবং একটি রামসার সাইট সেই সুন্দরবনে এ ধরনের দূর্ঘটনা আমরা কোনোভাবে এড়াতে পারতাম কি না? তবে তার আগে আরেকটি প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে প্রকৃতিপ্রদত্ত এই সম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা সত্যিই কতটুকু জানি অথবা জেনে থাকলে এর প্রতি আমরা কতটুকু অনুভূতিশীল?

আমরা সবা্ই কমবেশি জানি, সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশ নয় সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশে যত ধরনের প্রাকৃতিক বন আছে তার মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড় এই বন প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মিলনস্থল। সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় দশ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত। তবে এর দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই পড়েছে। এর সৌন্দর্য যেমন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে মুগ্ধ করে তেমনি এর বহুমাত্রিক সম্পদও অমূল্য। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সুন্দরবনের প্রায় প্রতিটি উপাদানের মূল্য অপরিসীম। এর একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে শতাধিক প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম আর রয়েছে বন্যপ্রাণী সম্পদ এবং জলজসম্পদের এক বিশাল ভাণ্ডার। যে প্রাণী নিয়ে আমরা সারাবিশ্বের কাছে বুক ফুলিয়ে অহংকার করি সেই বাংলার বাঘের আবাস হলো এই সুন্দরবন। একক বন হিসেবে সুন্দরবনে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাঘ। পশুপাখি, বন্যপ্রাণী ছাড়াও অর্থকরী, ঔষধিগুণ সম্পন্ন লাখ লাখ গাছের সমাহার রয়েছে এই বনে। এ ছাড়া সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র বলা হয়। এখানে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ আছে। সুন্দরবনের মধ্যে দুবলার চরের অস্থায়ী জেলেপল্লী, মাছ ধরা ও শুকানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখান থেকে মাছ সারা দেশে সরবরাহ করা হয় এবং দেশের আমিষের চাহিদার একটি বড় অংশ আসে এখান থেকে। এ ছাড়া কাঁকড়া ও চিংড়ি সুন্দরবনের অন্যতম গুরুত্ব্পূর্ণ সম্পদ। দেশের অর্থনীতিতেও চিংড়ির ভূমিকা অসামান্য। কাঁকড়ারও দেশে-বিদেশে বেশ ভালো চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছর চিংড়ি ও কাঁকড়া রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। দেশের মোট কাঠ ও জ্বালানির প্রায় ৪৫ ভাগই পাওয়া যায় সুন্দরবন থেকে। মাছ ও অন্যান্য সম্পদের ওপর সুন্দরবনের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- এই সুন্দরবন হাজারো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বুক পেতে দিয়ে রক্ষা করছে উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে। সুন্দরবনের এসব নীরব অবদান আমরা কীভাবে ভুলে যাই? একক একটি বন থেকে আর কতটুকু চাওয়া থাকতে পারে!

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রকৃতিগতভাবেই এই সুন্দরবন সম্পদের অধিকারী হয়েছি বলে এটিকে কি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি বা হচ্ছি? উত্তর যদি নেতিবাচক হয় এবং কেউ যদি বলেন আমরা তো সুন্দরবনকে মূল্যায়ন করে এটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছি, তাহলে আরেকটি প্রশ্ন এসেই যায়! কীভাবে এ রকম একটি সংরক্ষিত বনের ভেতরে তেলবাহী বা সারবাহী এসব বাণিজ্যিক জলযান চলতে পারে? দুর্ঘটনা তো পরের বিষয়! অনেকেই বলছেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ-রুট থাকলে ক্ষতি কী! দুর্ঘটনা তো দূর্ঘটনাই, এটা তো আর নিত্যদিন হচ্ছে না। বরং সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে চলাচল করলে দীর্ঘ নৌরুট থেকে মুক্তি পেয়ে সাশ্রয়ী উপায়ে বাণিজ্যিক কাজ চলে। কিন্তু তাঁরা সুন্দরবনের গুরুত্ব এবং এর জটিল প্রতিবেশব্যবস্থা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন কি?  একটি একক বন কেন এত বেশি সম্পদের আধার হয়ে আছে এই রহস্য তাদের জানা আছে কি? জানা থাকলে একটু দীর্ঘ হলেও অন্য কোনো নৌপথের সন্ধান তাঁরা করতেন। অথচ তাঁদের সেই পথের সন্ধান বহু আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা দিয়ে আসছেন। এ নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এমনকি মংলা বন্দর থেকে কোনো জাহাজের নিঃসরিত তেল সুন্দরবনের ভেতর প্রবেশ করলে সমূহ কি ক্ষতি হতে পারে- এ নিয়েও অনেক গবেষণা প্রতিবেদন রয়েছে। পরিবেশবাদীরা বহুবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে বার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন যে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সমূহ কী ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু আমাদের সম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা যথার্থ ওয়াকিবহাল নই। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এটাও ভাবা উচিত- সুন্দরবন আমাদের একক সম্পত্তি নয়। এটি বৈশ্বিক সম্পদ। সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান ও রামসার সাইট ঘোষণা করার জন্য আমরা আবেদন করেছিলাম। দরখাস্তে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। আবেদন জানিয়ে এটার সংরক্ষণ ও সুন্দর ব্যবস্থাপনার অঙ্গীকার করে আমরা এখন এটিকে এভাবে বিনষ্ট করতে পারি না। নিজেদের খামখেয়ালি ও অব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বের দরবারে আমরা নিজেদেরই ছোট করছি। তাই আর দেরি নয়। আর ভুল করা চলবে না।

আমাদের বোঝা উচিত সুন্দরবন ধ্বংসের পরিণাম ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এখনো যেটুকু আছে- সময় আছে তার সদ্ব্যবহার করে এগিয়ে যেতে হবে। সুন্দরবনের বিশাল সম্পদের ভাণ্ডার রক্ষায় প্রয়োজন আমাদের সদিচ্ছা, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সম্পদের পরিকল্পিত আহরণ। তবেই পরিবেশের সাম্যাবস্থা বজায় থাকার পাশাপাশি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থে আশীর্বাদ বয়ে আনবে।

মুশফিক আহমদ : প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক