প্রতিক্রিয়া

শিশুধর্ষণকারীরা কি মানুষ?

Looks like you've blocked notifications!

কিছু ঘটনা আপনার ভেতরটা এমনভাবে আঘাত করবে, যখন শক্ত হাতে কিবোর্ডে প্রতিবাদ করতে গেলেও হাত আটকে যাবে! এসব ঘটনায় প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না; কিন্তু ভেতরটা জ্বলতে থাকে। পাঁচ বছরের একটা শিশুকে যৌনাঙ্গ কেটে-ছিঁড়ে ধর্ষণ করার পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার শরীরে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার চেয়ে নৃশংস ঘটনা আর কী হতে পারে, জানা নেই! পূজা নামের মেয়েটা যখন কৈশোরে পা দেওয়ার আগেই ধর্ষণের শিকার হয়, তখন বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। বলছি না, একজন বাড়ন্ত কিশোরীকে ধর্ষণ করা যায়। কিন্তু ঘাতক কাঠ ব্যবসায়ী সাইফুল পাঁচ বছরের একটা কন্যাশিশুর মাঝে এমন কী পেল, যা তাকে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে প্রলুব্ধ করল? এই একটা প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে গেলে সমাধান পাওয়া যাবে না। তবে অবস্থাদৃষ্টে সামাজিক এ অবক্ষয়ের শেষ পরিণতি যে কী হতে পারে, তার প্রতিকারে আশু পদক্ষেপ নিয়ে এক্ষুনি ভাবা প্রয়োজন।

চল্লিশ বছর বয়সী একজন পরিণত যুবক পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে ১৮ ঘণ্টা আটকে রেখে পাশবিক অত্যাচার করতে পারে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! আঁতকে ওঠে মন, গা ঘিনঘিন করে। নিন্তাতই মেয়ের বয়সী কিংবা তার চেয়ে ছোট পূজার মনে লোকটাকে নিয়ে কোনো কু-ধারণা থাকার কথা নয়। পূজার পারিবারিক সূত্রই বলছে, মেয়েটি লোকটিকে ‘বড় আব্বা’ বলে ডাকত। পার্বতীপুর উপজেলার জমিরহাট তকেয়াপাড়া গ্রামের সুবাস চন্দ্র দাস খুব সাধারণ একজন মানুষ। স্ত্রী রূপালী রানী আরো সহজ সরল। তাঁদের সঙ্গে ঘাতক ও তার সহযোগী আফজাল কবিরাজের কোনো পারিবারিক বিরোধ ছিল বলেও জানা যায়নি। তাহলে ছোট ফুটফুটে মেয়েটির ওপর কেন এই পাশবিকতা? অপ্রতিরোধ্য পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কি এর জন্য দায়ী? যেখানে পাঁচ বছরের একটা মেয়েও পুরুষের কাছে নিরাপদ নয়। নিরাপদ নয় তার প্রতিবেশীর কাছে, যাকে কি না সে ‘বড় আব্বা’ বলে সম্বোধন করত!

মেয়েটিকে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে? সুন্দর এ ভুবনে যার নিষ্পাপ পদচারণা মাত্র পাঁচ বছরের, এরই মাথায় তাকে চলে যেতে হবে? কী দোষ ছিল তার? একজনের পাশবিকতার শিকার হলো সে, যেখানে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। এর দায় আবার তাকেই বয়ে বেড়াতে হবে! এরপরও এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার তার নেই? কী অদ্ভুত এক সমাজের আমাদের বসবাস! ধর্ষককে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের ছয় দিন লেগে গেল। এ ঘটনায় মানুষের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। তেমনভাবে কেউ প্রতিবাদও করছে না। সবাই কি এটাকে মেনে নিল! এর প্রতিবাদ না করলে যে আমরা প্রত্যেকেই ধর্ষকের কাতারে পড়ছি, তা কি কেউ উপলব্ধি করছে না? আসলে কেন এই অবস্থা? এর আগে তনু, রিসা, খাদিজার ওপর নৃশংসতার চেয়ে এটা কি কম কিছু? না, পূজা বেঁচে থাকার সুবাদে সবাই ভাবছে ধর্ষিত হলে কী হবে, বেঁচে তো আছে! হায়রে সমাজ, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, ধিক্কার এই মানসিকতাকে। যে সমাজ একটা শিশুর নিরাপদ বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে পারে না, যেখানে পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে যৌন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়—সে সমাজ আর যা-ই হোক, মানুষের সমাজ হতে পারে না। এটা পশুত্বকেও হার মানায়! আপনার-আমার মা, বোন কেউ এ সমাজে নিরাপদ নয়! কী ভয়ংকর, বীভৎস, নির্মম, জঘন্য!

রংপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত পূজা বেঁচে যাবে, এটা নিশ্চিত। বলতে পারেন, জীবন ফিরে পেল। যেহেতু তাকে মারার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সে হিসেবে সৌভাগ্য বলা যেতে পারে। কিন্তু জীবনভর যে তাকে ধর্ষণের দায় বয়ে বেড়াতে হবে। এ দায়ভার কি অন্য কারো ওপর বর্তায় না? পাঁচ বছরের একটা মেয়ে যে ঠিকমতো যৌনাঙ্গ নির্দিষ্ট করতে পারে কি না, তা সন্দেহের বিষয়, তাকে যখন ধর্ষণের শিকার হতে হয় সে দায় তার ওপর বর্তায় না। সে দায় আপনার, আমার। সে দায় সমাজের। সে দায় সমাজের বিকৃত মানসিকতার। একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বারবার মন চায়। পাঁচ বছরের একটা মেয়ে কীভাবে ৪০ বছরের একটা পুরুষের ভোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে? মানসিকতার বিকাশ বলতে কি কিছু আছে এ সমাজে? না আদিমতা আমাদের সেই পশু শ্রেণিতেই বেঁধে রেখেছে? সভ্যতা, সমাজ, সংস্কৃতি বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব কি এ সমাজে বিদ্যমান? না, রাষ্ট্র এর আগেও কোনো দায় নেয়নি, এটারও নেবে না। জনরোষানলে বিচারের জন্য মুখোমুখি করবে ঠিকই; কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়া হিমঘরে পড়ে থাকবে। আসলে আদৌ কি এসবের কোনো বিচার হবে না? এ সমাজ টিকিয়ে রাখতে গেলে অন্তত ধর্ষণের মতো জঘন্য পাপের বিচার করা উচিত।

পূজার শরীর আজ অসংখ্য কাটা-ছেঁড়ার দাগে ক্ষতবিক্ষত। শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ডাক্তার বলছেন, এই জীবনে তাকে ফেরানো গেলেও তার ক্ষতের এ চিহ্ন মোছার নয়। পাঁচ বছরের কন্যাশিশুটি কখনো হয়তো বা মা হতে পারবে না—এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন ডাক্তাররা। বিষয়টা অনেক পরের হলেও ভাবনার জন্ম দেয়। মানুষ কতটা পশু হতে পারে যে এ রকম নির্মমভাবে পাশবিক অত্যাচার করে! পূজার শরীরে ঘুণ  ধরানো হলো। ঘুণ ধরেছে সমাজেও। পূজার শরীর থেকে চিহ্ন মুছে যাবে, কিন্তু ভেতরের ক্ষতটা রয়ে যাবে সারা জীবন। তাই বলে সমাজের মধ্যে এই ঘুণ বাঁচিয়ে রাখলে এ সমাজ মানুষের সমাজ হিসেবে টিকে থাকবে না। এ সমাজ হবে মানুষভিত্তিক এক পশুর সমাজ! সর্বশেষ প্রশ্ন একটাই, এ ধরনের পশুত্ব আর কত? এ থেকে কি বের হওয়ার কোনো উপায় নেই? সুস্থ হও পূজা। ফিরে এসে সমাজের মুখে ছুড়ে দাও প্রতিবাদের প্রবল বার্তা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।