নেপালের দিনলিপি-৪

হারবে না হিমালয়কন্যা

Looks like you've blocked notifications!
গোর্খার পাহাড়ি এলাকায় দুর্বল কাঠামোর ঘর টিকতে পারেনি ভূমিকম্পে। ছবি : লেখক

কাঠমান্ডু এবং তার আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, নেপালি গ্রামের প্রকৃত অবস্থা জানতে দূরে কোথাও যাব। সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব গোর্খা জেলায়।

পয়লা মে সকাল ৭টা। আমি তখন বাংলাদেশ দূতাবাসের শরণার্থীদের মধ্যে একজন। অন্যদের সঙ্গে পার্থক্য, তাঁরা দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন আর আমি আছি সংবাদ সংগ্রহে আরো গভীরে যাওয়ার অপেক্ষায়। সাংবাদিকতা জীবনটাই এমন। অনেক অ্যাডভেঞ্চার, অনেক গল্প, অনেক অভিজ্ঞতা এক জীবনে আর কোনো পেশায় পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। তাই সকাল ৭টায় যখন রেন্ট-এ-কারের গাড়ি হাজির, তখন একাই বেরিয়ে পড়লাম কাঠমান্ডু থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরের গোর্খা জেলার উদ্দেশে। আমার গাড়ির চালকের নাম রেশম।

চলতি পথে জানলাম, রেশমের দুই সন্তান আর স্ত্রী রয়েছে। বয়স প্রায় ৪০, যদিও দেখে বোঝা যায় না। তো, সেই রেশম আগের রাতেও ঘুমিয়েছে মাত্র চার ঘণ্টা। চোখ দুটো লাল, কারণ তার আগের চার দিন সে ঘুমাতেই পারেনি। নিতান্তই পেটের দায়ে আজ কাজে এসেছে। ভূমিকম্পের ভয়ে চার রাত নির্ঘুম কাটিয়ে কীভাবে সে আমাকে নিয়ে সোয়া ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে, তা ভেবে কিছুটা আতঙ্কিত বোধ করলেও তা নিজের মধ্যেই চেপে রাখলাম। উপায় কী, কাঠমান্ডুতে তখন ড্রাইভার সংকট। সবাই পালাচ্ছে রাজধানী ছেড়ে—কেউ ভয়ে আর কেউ বা গ্রামের আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে। চলতি পথেই আমার অনুমতি নিয়ে রেশম তার বোন আর ভাইকে গাড়িতে তুলে নিল। গোর্খা যাওয়ার পথে ৪০ কিলোমিটার পরেই তার বোনের বাসা। কোলে একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা। তার চোখে আমি রীতিমতো বিস্ময়কর, বিশাল শরীরের কালোমতো এক পাহাড়!

বেশি সকালে বের হওয়ায় নাশতা সারা হয়নি। তাই ঘণ্টা দুয়েক চলার পর সকাল ৯টার দিকে রেশম গাড়ি থামাল এক টং দোকানে, সেখানকার খাবার নাকি ভালো। ভেতরে ঢুকে দেখলাম চাউমিন, অর্থাৎ শসা দিয়ে রান্না করা ঝালঝাল নুডলস ছাড়া কিছু নেই। কী আর করা, সেটা খেয়েই রওনা দিলাম। গলা ভেজানোর জন্য একদিনে অবশ্য পানি খাওয়া হয়েছে কমই।

দোকানগুলোতে বোতলজাত পানির অভাব থাকায় কাচের বোতলের কোমল পানীয়র ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে অনেকটাই। অন্ততপক্ষে রিপোর্ট করতে এসে পানিবাহিত রোগের পাল্লায় পড়লে দেখার কেউ থাকবে না, সেটা আমি প্রথম দিনেই বুঝে গিয়েছিলাম, তাই এ সাবধানতা।

প্রায় ঘণ্টা পাঁচেকের পথ পাড়ি দিলাম ত্রিশূলী নদীর পাশ ধরে। একসময় ত্রিশূলী নদীর মোহনায় পৌঁছালাম। রেশম জানাল, বিপরীত দিক থেকে বয়ে আসা নদীটির নাম মারচান্ডী। আর দুই নদী মিলে নারায়ণী নাম নিয়ে বয়ে চলেছে দক্ষিণে। মারচান্ডী নদী ধরে আরো আধঘণ্টা পথ পেরিয়ে পৌঁছালাম গোর্খা বাজারে। সেখান থেকে আরো ২০ মিনিটের উঁচু-নিচু গ্রামীণ পথ ধরে নাম-না-জানা এক এলাকায়। সেখানেই গাড়ি চলাচলের পথ শেষ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, দূরে পাহাড়ের ওপরে পসলাং গ্রাম ধসে গেছে। আমার গন্তব্যও সেখানে। এই গ্রামের খবর পেয়েছিলাম বাংলাদেশ দূতাবাসের এক নেপালি অফিস সহকারীর কাছ থেকে। তাঁর বাড়িও গোর্খাতেই।

গাড়ি ছেড়ে প্রায় দুই মাইল পথ পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটলাম একাই, রেশম গাড়ি ছেড়ে নড়বে না। অচেনা জায়গা, কখন কী হয় বলা তো যায় না। পাহাড়ের কোল ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেলাম পাঁচ-ছয়জন নেপালি তরুণীর। তাঁদের গ্রাম আরো বহুদূরে—দুদিনের পথ; তার মধ্যে একদিন গাড়িতে যেতে হবে আর একদিন হেঁটে। তবে আমার মতো ভেতো বাঙালি সমতলের মানুষ হাঁটতে গেলে দুদিন লাগিয়ে ফেলাও অসম্ভব নয়। তরুণীরা বললেন, তাঁদের গ্রামের খবর জানেন না। কারণ, পাহাড় ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁরা নিজেরাও যেতে পারছেন না। তাই আশ্রয় নিয়েছেন আরেক বিধ্বস্ত গ্রাম পসলাঙে।

ঘণ্টাখানেক পথ হেঁটে সরু পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছালাম পসলাঙে। এর পর নিজের চোখে যে দৃশ্য দেখলাম, তা যেকোনো হলিউডি অ্যাকশন সিনেমার সেটকেও হার মানায়। গোটা গ্রাম বিধ্বস্ত। একটি মাত্র বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গায়ে অসংখ্য ফাটল নিয়ে। গ্রামের ৫০ জন মানুষ মারা গেছেন ভূমিকম্পে। তাঁরা তো অবাক, বাংলাদেশ নামের এক দেশ থেকে তাঁদের গ্রামে সাংবাদিক বা পত্রিকার লোক এসেছে, যেখানে তাঁদের নিজ দেশেরই কেউ আসেনি।

ভিড়ের মধ্যেই দেখা পেলাম স্বরাজ ভাটরাই নামের এক ছেলের। পড়াশোনা করে কাঠমান্ডুতে। গ্রাম বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়ে সে এসেছে সাহায্য করতে, নতুন জীবন গড়তে। স্বরাজই জানাল, ২৬ তারিখের দ্বিতীয় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বারপাক এলাকার সবচেয়ে কাছের গ্রামটিই হলো পসলাং। স্বরাজকে দোভাষী বানিয়ে কথা বললাম গ্রামবাসীর সঙ্গে। তাঁরা জানালেন তাঁদের একান্ত মনের কথা। সমাজ, রাজনীতি, নেতৃত্ব সবকিছু নিয়েই কথা হলো। পেশার খাতিরে সব নাই বা বললাম। তবে শুধু এটুকু জেনে রাখুন, বাংলাদেশ তাঁদের কাছে ভারতের চেয়েও অনেক বেশি আপন। আর আমাদের দেশের নামটাও তাঁদের কাছে পরিচিত, বন্ধু হিসেবেই।

রিপোর্টের কাজ করার সময় একটা কথাই বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন আরো অসংখ্য গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেগুলোতে কোনোদিনই কোনো সাংবাদিক যাবেন না, পৌঁছাবে না সরকারি কিংবা বেসরকারি ত্রাণ—কোনোকিছুই। কিন্তু তাঁরা আবারো জীবন সাজাবেন পাহাড়ের কোলে, প্রকৃতির খোলা বাতাসে।

মধ্য দুপুরে হিমালয়ের ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক আমাকে শিহরিত করছিল সে সময়, দূর থেকে হিমালয়ের চূড়াও দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। বিধ্বস্ত গ্রামের দুঃখকে কিছুক্ষণের জন্য পাশে সরিয়ে হিমালয় যেন আমার চোখ জোড়াকে বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তার অদ্ভুত সুন্দর বরফঢাকা চূড়ায়।

মনে মনে বললাম, নেপাল তুমি কখনোই হেরে যাবে না। হিমালয় তার মেয়েকে কখনোই বিমুখ করবে না। আবার আসবে জীবন, আবারো ত্রিশূলী, মারচান্ডী কিংবা নারায়ণী তার মন্থর রূপ ছুড়ে ফেলে হয়ে উঠবে স্বচ্ছ স্ফটিক প্রবাহের উত্তুঙ্গ নাচিয়ে। যার কুলকুল ধ্বনিতে কোনো এক নেপালি কিশোরী গাইবে নতুন জীবনের গান। তাঁর মনের মানুষটিকে ঘিরে নতুন করে ঘর বাঁধার সে গান ছড়িয়ে পড়বে পাহাড়ের বাতাসে, ছড়িয়ে যাবে সমস্ত নেপালে। হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাবে কোনো এক বিদেশী বঙ্গসন্তানকে, বলবে নমস্তে।

(শেষ)