সিটি করপোরেশন নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশা ছিল, সিটি করপোরেশন নির্বাচন গণতন্ত্রের জানালা খুলে দেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আন্দোলন মোকাবিলার কৌশল হিসেবে নির্বাচন ঘোষণা করে। তারা ভেবেছিল, নির্বাচনী ডামাডোলে আন্দোলন বেকায়দায় পড়বে। তারা চিন্তা করেছিল, আগের মতোই গোস্বা করে নির্বাচনে আসবে না বিএনপি। আর তারা ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। কিন্তু ঘটনা সে রকম ঘটেনি। নির্বাচন কৌশলটা আওয়ামী লীগের জন্য শতভাগ বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
এই আশঙ্কাকে আশায় পরিণত করার জন্য যেকোনো মূল্যে বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনা নস্যাৎ করার জন্য আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয় বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। বিএনপি ছিল সাংগঠনিকভাবে নির্যাতিত, রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা এবং অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু। প্রফেসর এমাজউদ্দীনের মতো নাগরিক বিএনপিকে সম্মত করাতে না পারলে হয়তো নির্বাচনে বিএনপি যেত না। বিএনপির সান্ত্বনা এটুকু যে, তারা শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণতন্ত্রের জানালা খোলার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের এই ইতিবাচক ভূমিকা ঘরে-বাইরে সমালোচিত হয়েছে। কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা করেছেন (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬ মে-২০১৫)। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার নিশ্চিত করছেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তিনি আরো অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আসাটা বিএনপির নাটক ছিল। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করাই ছিল উদ্দেশ্য। তিনি আরেকবার নির্বাচনের দিন বিএনপির সহিংস ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির দাবি করেন, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর এত অবাধ, সুষ্ঠু ও সংঘাতমুক্ত নির্বাচন আর হয়নি। ইতিহাস সম্মিলনীর অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মনে করেন, তিন সিটি নির্বাচন ছিল সংঘাতমুক্ত। গণমাধ্যমগুলো বিভক্ত, নিরপেক্ষ নয় বলেও তিনি অভিযোগ করেন। যা হোক, নাগরিক-সাধারণের সন্তুষ্টি—অবশেষে নির্বাচন তো হলো!
দৃশ্যত এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ চট্টগ্রামের হারানো কর্তৃত্ব এবং ঢাকার প্রায় ফসকে যাওয়া কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজধানীর গুরুত্ব আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে। বিএনপি পারেনি। স্মরণ করা যেতে পারে যে, বিগত আন্দোলনগুলোয় সারা দেশে আন্দোলন সফল হলেও রাজধানীতে ব্যর্থ। নানা কৌশলে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থেকেছে রাজধানী। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন এসেছে, বিএনপির নেতাকর্মীরা আরো হতাশ হয়েছেন। এর পাশাপাশি বিএনপি পুনর্গঠন করে পুনরায় আন্দোলনের খবরও বেরিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, অবৈধ নির্বাচনের বৈধতা দিতে আওয়ামী লীগ সক্ষম হয়েছে! এ ক্ষেত্রে গোয়েবলসিও সূত্রটি উল্লেখ করা যায় : একটি মিথ্যা কথা শতবার বললে সত্য হয়ে যায়। অনায়াসে অনর্গল কীভাবে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করা যায়—এ নির্বাচন আমাদের তা শিখিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচন-পরবর্তী খোলা জানালার আশা যখন আশঙ্কায় পরিণত হলো, তখন নাগরিক-সাধারণ আরো হতাশ হলেন। গণতন্ত্রের সুবাতাসের আশায় আশায় যারা দিন গুনছিলেন, তাদের সে আশায় গুড়ে বালি পড়ল। বিএনপি পরাজিত হলেও নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটবে, গণতান্ত্রিক অধিকার পাবে—এই অশা ছিল। কিন্তু কর্তৃত্বের নির্দেশ আর মন্ত্রীদের উচ্চারণ দেখে মনে হয় না যে বিএনপি সেই হারানো দিন ফিরে পাবে। বিএনপি নেত্রী জেলায় জেলায় গণসংযোগের যে পরিকল্পনা করেছেন, তাকে সন্ত্রাসের সম্প্রসারণের প্রয়াস বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাছান মাহমুদ। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘শুধু সাংবাদিকরাই বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’ সৈয়দ আবুল মকসুদ এ অবস্থায় বিরাজনীতিকীকরণের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রটি যদি প্রতারণায় পরিণত হয়, তখন জাতি বিপর্যয়ে পড়ে।’ জামায়াত নির্মূলের পর যখন সরকার বিএনপি নির্মূলে উদ্যোগী, তখন কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জামায়াত উত্থানে আতঙ্কিত। তিনি মন্তব্য করেন, ‘শত্রুপক্ষের অবস্থানে শূন্যাবস্থা মঙ্গলজনক নয়।’ তিনি মনে করেন, বিএনপি নির্মূলে দেশের মঙ্গল হবে না। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শত্রুদের অবশ্যই নিপাত করতে হবে। এই শত্রুটি হচ্ছে জামায়াত, হেফাজত প্রভৃতি দল। বিএনপি গণতন্ত্রের শত্রু নয়, দলটিকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বলা চলে।...বিএনপি নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও অমিতাচার সত্ত্বেও দলটিকে উপেক্ষা করা যায় না, কারণ তার জনসমর্থন আছে। এই দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তার শূন্যস্থান পূরণ করবে জামায়াত কিংবা অনুরূপ কোনো অশুভ শক্তি’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬ মে-২০১৫)। একই আতঙ্ক সুশীল সমাজের। সিটি নির্বাচনগুলোতে ইসলামী শক্তি হিসেবে চরমোনাই পীরসাহেবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন প্রার্থীদের তৃতীয় অবস্থান অর্জনে আতঙ্কিত বাম বুদ্ধিজীবীগণ। তাঁরা মনে করেন, সিটি নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান উদ্বেগজনক। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত (দৈনিক যুগান্তর, ৫ মে-২০১৫)। ‘সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ এবং সরকারের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিচ্ছিন্নতা বোধকে পুঁজি করে অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত শক্তিগোষ্ঠীও রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসতে পারে। এরা হতে পারে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী কিংবা কোনো স্বৈরশক্তি’—এ মন্তব্য প্রফেসর ড. মাহবুব উল্লাহর।
আওয়ামী লীগের নেতারা যথার্থই অভিযোগ করেছেন যে, এটি জাতীয় নির্বাচন না হওয়া সত্ত্বেও বিদেশি সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো এ নির্বাচনের ব্যাপারে নানা রকম মন্তব্য করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইসি) এ নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের অগ্রহণযোগ্যতা ব্যক্ত করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। সর্বশেষ সংবাদে জাতিসংঘ বাংলাদেশের সব পক্ষকে রাজনৈতিকভাবে একটি সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে এ নির্বাচন নিয়ে ঘরে-বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারকে এত কথা শুনতে হতো না, যদি তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য না করে তুলত ।
এই সিটি করপোরেশন নির্বাচন ওই অগ্রহণযোগ্যতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান সংকটকে আরো জোরদার করে তুলেছে। যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতির হাঁড়ির খবর রাখেন, তাঁরা আতঙ্কিত। আগামী বছরগুলোতে সংকটের রাজনৈতিক সমাধান সুদূরপরাহত। বিজ্ঞজনরা আতঙ্কিত, এই সংকট যেন বাংলাদেশকে একটি অঘোষিত যুদ্ধাবস্থার দিকে ঠেলে না দেয়! এসব বিষয় সরকার গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে বলে মনে হয় না—তবে বিদেশি অব্যাহত চাপ, সরকারের জন্য অস্বস্তিকর বলে মনে করে সংবাদমাধ্যম। আর একটি বিষয়, সমাজতাত্ত্বিকদের উপলব্ধি এ রকম যে, এ দেশের ক্ষমতাসীন দলগুলো যুক্তি ন্যায়বোধ কিংবা গণ-আকাঙ্ক্ষার চেয়ে আন্দোলন, চাপ প্রয়োগ এবং শক্তির কাছে বশ্যতাকে শ্রেয়জ্ঞান করেন।
বর্ণিত অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ এবং বহিঃস্থ চাপ ও কৌশল অবশেষে একটি সম্ভাব্য নির্বাচনের দুয়ার খুলে দিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তাঁদের এ আশাবাদের ভিত্তি বাংলাদেশের হৃদয়ে গণতন্ত্রের অবস্থান। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিদর্শন করতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের ডিএনএতে গণতন্ত্র রয়েছে। সামগ্রিক অর্থে বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির গরিষ্ঠ অংশ গণতন্ত্রের সপক্ষে রয়েছে। দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, জঙ্গিগোষ্ঠী কিংবা স্বৈরশক্তির উত্থান ঠেকাতে গণতন্ত্রের অনুশীলন অপরিহার্য। শতফুল ফুটতে না দিলে বাগানে আগাছা জন্মাবে নিঃসন্দেহে। আর এই আগাছা বাংলাদেশ রাষ্ট্র নামক বৃক্ষকে জাপটে ধরে এর অস্তিত্ব বিলীন করে ফেলবে।
তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘জিতল আওয়ামী লীগ, হারল গণতন্ত্র’। দেশের সব শীর্ষ দৈনিকের প্রতিবেদনে গণতন্ত্রের পরাজয়কে মুখ্য বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। রাষ্ট্র তথা গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় নির্বাচনকে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করা হয়। নির্বাচনই গণতন্ত্রের ভিত্তি। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের আস্থা-বিশ্বাস নষ্ট হলে খোদ রাষ্ট্রব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং জনস্বার্থে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে আমাদের গণতন্ত্রের যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। মনীষী টমাস হিলের ভাষায় বলা যায়, ‘ডেমোক্রেসি মে লজ মেনি ব্যাটলস, বাট ইট উনস দ্য লাস্ট’।
ড. আবদুল লতিফ মাসুম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।