কৃষক আন্দোলন

টিপু পাগলার স্বাধীন রাষ্ট্র

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের কৃষক বরাবরই কর্মঠ, শান্ত ও নিরীহ প্রকৃতির। এরা ক্ষেতে ফসল ফলায় এবং শাসক-শোষকের অত্যাচার সহ্য করে। অত্যাচারকে তারা ভেবে নেয় নিয়তি। সেই অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। তখন এ বিদ্রোহকে সামাল দেয়া সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে শাসকগোষ্ঠীর। এমনই একটি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে, যা ইতিহাসের পাতায় ‘টিপু পাগলার বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। ওই বিদ্রোহ এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, তারা জমিদার ও ইংরেজদের বিতাড়ন করে সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রটি টিকেছিল প্রায় দুই বছর।

আলোচিত বিদ্রোহের নেতা টিপু জন্মগ্রহণ করেন সুসং পরগনার অন্তর্গত বর্তমান নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার জারিয়া ইউনিয়নের লেটুয়াকান্দি গ্রামে। টিপু ছিলেন গারো সম্প্রদায়ের একজন সাধারণ গৃহস্থ। তিনি ওই সময় এক অভিনব ধর্মমত প্রচার করতেন, যার মূলমন্ত্র- ‘সকল মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্টি, তাই কেউ কারো অধীন নয়।’ প্রচলিত ধর্মের সঙ্গে তাঁর ধর্ম বাণীর মিল না থাকায় তাঁর নাম হয়ে ওঠে টিপু পাগলা। আর তাঁর অনুসারীরা হয়ে ওঠে পাগলাপন্থী। টিপুর শিষ্যরা দাড়ি-গোঁফ রাখতেন না, বাড়িতে কোনো পশুপাখিও পালন করত না। তারা ঈশ্বর ছাড়া আর কারো কাছেই মাথা নত করত না। তাঁর বাড়িতে থুতু ফেলা ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

টিপু পাগলার পাগলাপন্থী ধর্ম প্রচারের সময় অর্থাৎ ১৮২০ সালে শেরপুরের জমিদারি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এই ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে প্রত্যেক জমিদারের খরচও বেড়ে যায়। তারা এই বাড়তি খরচের অর্থ কৃষকের কাছ থেকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আবওয়াব, মাথট ইত্যাদি নামে নতুন খাজনা বসানো হয়। বেড়ে যায় পুরোনো খাজনাও। এসব খাজনা আদায়ের জন্য নামিয়ে দেওয়া হয় পাইক, পেয়াদা, বরকন্দাজ। খাজনা দিতে না পারায় কৃষককে কয়েদ করা হতে থাকে। পেয়াদাদের সঙ্গে কোথাও কোথাও মারপিট, কৃষকের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। নিপীড়ন সইতে না পেরে কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়, অনেকেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ সময় এ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন পাগলাপন্থী টিপু পাগলা। শত শত উৎপীড়িত কৃষক তাঁর সাম্য মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে বিদ্রোহে যোগ দেয়। তারা বন্ধ করে দেয় জমিদারের খাজনা। কোথাও কোথাও জমিদারের পাইক-পেয়াদাদের সঙ্গে কৃষকের সংঘর্ষের ঘটনা তীব্র আকার ধারণ করে। কোথাও খুন-গুমের ঘটনাও ঘটতে থাকে। একদিন হাজার হাজার কৃষক শেরপুরে জমিদারবাড়িতে হামলা চালায়। ব্যাপক লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে সব কিছু তছনছ করে দেয় তারা। এতে ভীত হয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান জমিদাররা। তাঁরা সপরিবারে আশ্রয় নেন কালীগঞ্জের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডেম্পিয়ারের কাছারি বাড়িতে। প্রজাদের বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভ দেখে ভীত হয়ে পড়েন ডেম্পিয়ারও। তিনি নাসিরাবাদ (বর্তমান ময়মনসিংহ) কালেক্টরেট সাহেবকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন।

এদিকে টিপুর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা শেরপুর (বর্তমান জেলা শহর) দখল করে সেখানে নতুন রাষ্ট্র স্থাপনের ঘোষণা দেন। প্রতিষ্ঠা করেন বিচার ও প্রশাসন বিভাগ। টকসু নামের এক ব্যক্তিকে জজ এবং দ্বীপচান নামের একজনকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতে থাকে নতুন রাষ্ট্রের বিচার ও শাসন বিভাগ। বিদ্রোহের নেতা টিপু পার্শ্ববর্তীর গড়জরিপা নামের এক পুরাতন দুর্গে আশ্রয় নিয়ে নিজের বাসস্থান গড়ে নতুন রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন।

এদিকে ফকির ও সন্ন্যাস বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে রংপুরের সেনানিবাস তুলে এনে সন্ন্যাসীগঞ্জে (বর্তমান জামালপুর) স্থাপন করা হয়। ফকির ও সন্যাসী বিদ্রোহ দমন করতে এসে বিদ্রোহী টিপুপন্থীদের মুখোমুখি হতে হয় ইংরেজদের। ডেম্পিয়ারের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষার্থে এগিয়ে আসে সৈন্যরা। ১৮২৭ সালে রাধাচরণ দারোগার নেতৃত্বে বেশ কিছু সৈন্য নিয়ে ঘেরাও করা হয় গড়জরিপার টিপুর ঘাঁটি। ভীষণ যুদ্ধ শেষে বেশ কিছু সঙ্গীসহ আটক হন টিপু পাগলা। ময়মনসিংহ সেশন জজ আদালতের বিচারে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১২৫৯ বাংলা সনের জ্যৈষ্ঠ মাসে কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যান বিদ্রোহের নেতা টিপু পাগলা। তাঁর মৃত্যু দিবসে ময়মনসিংহ অঞ্চলে সংঘটিত ভীষণ টর্নেডো, যার ক্ষয়ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণ। টিপু পাগলার অলৌকিক ক্ষমতাবলে এই টর্নেডো সংঘটিত হয় বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। টিপু পাগলার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে বাংলার কৃষক বিদ্রোহের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়ের।

কৃষকদের মধ্যে টিপুর প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে জামালপুরের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডানো লিখেছেন, টিপুর মৃত্যুর পর তাঁর বাড়ি শিষ্যদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হতো। তার শিষ্যরা মনে করত যে, টিপুর প্রতি ভক্তি থাকলে যে কোনো অসাধ্য সাধন সম্ভব। এ জন্য তারা জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকত।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা