ক্রিকেট

একটি জয় ও অনেক প্রশ্নের উত্তর

Looks like you've blocked notifications!

‘আইসিসি শুধু শুধু বাংলাদেশের জন্য পয়সা খরচ করছে। বহু অর্থ ব্যয় করার পরও বাংলাদেশের খেলার কোনো উন্নতিই হয়নি। তারা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি অর্থ পাচ্ছে, কিন্তু লাভ কিছুই হচ্ছে না। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এত অর্থ কেউ ব্যয় করেনি, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট একটুও এগোয়নি।’

কথাগুলো জিওফ্রে বয়কটের। একবার না, বহুবার বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য তিনি করেছেন। এখানে বয়কট কেবল একটি উদাহরণ মাত্র। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ রকম কটাক্ষ সিধু, রমিজ রাজা থেকে শুরু করে হালের বীরেন্দ্র শেবাগ পর্যন্ত করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেওয়ার দাবিও তোলা হয়েছিল। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেট উন্মাদনার কাছে চাপা পড়ে গেছে সব সমালোচনা। বেবি স্টেপ দিয়ে পথচলা শুরু করা বাংলাদেশ এখন জোরে হাঁটা শুরু করেছে। নয়তো নাক উঁচু বয়কটের দেশকে ডেকে এনে কীভাবে মাত্র তিন দিনে টেস্ট হারিয়ে দেয়। এমন লজ্জা নিয়ে বয়কট সাহেবদের ঘুম হয়েছে তো। তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের কাছে তার ইংলিশ আধিপত্য নির্মমভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

শুরুটা গত বিশ্বকাপ দিয়েই হয়েছিল। এই ইংল্যান্ডকে হারিয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল মাশরাফির দল। এর পর দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে আরেকটা শুরু, তার পর ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে একদিনের ক্রিকেটে বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশকেই দেখেছে সবাই। বাংলাদেশ আন্ডারডগের তকমা ফেলে ফেভারিটদের কাতারে গিয়ে হাজির হলো। এই তো, বাংলাদেশ সফরের শুরুতেই ইংল্যান্ডদের ওডিআই দলের ক্যাপ্টেন জস বাটলার বলেছিলেন, তাদের আন্ডারডগ হতে আপত্তি নেই।

কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট হলো ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ভার্সন, এতে দীর্ঘশ্বাসই কেবল শোনা গেছে। একের পর এক ব্যর্থতা। তার চেয়েও বড় কথা, আশ্চর্যজনকভাবে টেস্ট ক্রিকেট থেকে লম্বা ছুটি। এখন থেকে কি সেই ধারা বদলাবে? উত্তর সময়ের হাতেই তোলা রইল। তবে টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকের কণ্ঠে শোনা গেল, আরো বেশি টেস্ট খেলার আকুতি। ১১ বছর আগে টেস্ট ক্যাপ পরা মুশফিক নিজে এই পর্যন্ত খেলেছেন ৫০টি টেস্ট। এমন টেস্টখরা দিয়ে কতটুকুই বা আগাতে পারে। সেইসঙ্গে নানা সমালোচনা ও আক্রমণ ত ছিলই। এমনকি ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছ সব মিলিয়ে ৯৫টি, যার মধ্যে মাত্র আট ম্যাচে জয় লাভ করে। ড্র করেছে ১৫টি ম্যাচ। তবে বেশির ভাগ জয়ই হচ্ছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। দ্বিতীয় সারির ক্যারিবিয়ান দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের আছে দুটি জয়। তাই পূর্ণ শক্তির ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই জয় নতুন এক পথের দিকে যাত্রা।

অভিষেকের পর থেকে যতই দিন গড়িয়েছে, টেস্ট ক্রিকেট থেকে ক্রমে দূরে সরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন দুর্দশাসম্পন্ন অবস্থা থেকে হঠাৎ এই বদলে যাওয়ার হেতু কী? এটি কি জাদুকরি কিছু, নাকি ধারাবাহিক পরিশ্রমের ফসল। প্রথমত, এ দেশের মানুষ সব সময় ক্রিকেট নিয়ে আবেগপ্রবণ। উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সেও ক্রিকেট একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও ক্রিকেটের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাই ক্রিকেটকে বাংলাদেশে বাজারজাত করাটাও বেশ লাভজনক। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের গ্ল্যামার, অর্থ ও জনপ্রিয়তার হাতছানিও বেড়েছে বহুগুণে। তৈরি হয়েছে আশরাফুল, মাশরাফি, সাকিবদের মতো ক্রিকেট আইকন। যাঁদের এখন দেবতুল্য জ্ঞান করা হয়। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে নতুন তারকাও। প্রতিটি পজিশনে তৈরি হয়েছে একাধিক অপশন। মুস্তাফিজ, মিরাজ কিংবা সাব্বিরের মতো প্লেয়াররা উঠে আসছেন। ক্রিকেটে আসছে আরো টাকা। ক্রিকেট ঘিরেই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাণিজ্য। আরো অনেক নতুন ছেলেমেয়ে ক্রিকেটে এগিয়ে আসছে। সুতরাং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই জয়কে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন একটি বাঁকবদল হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য সামনের পথ আরো বিপদসংকুল হবে নিঃসন্দেহে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক যত সাফল্য, সব দেশের মাটিতে। বয়কটদের মুখ চিরতরে বন্ধ করতে হলে এই সাফল্য ধরে রাখতে হবে দেশের বাইরেও। সে ক্ষেত্রে এসিড টেস্ট হতে পারে সামনের নিউজিল্যান্ড সফর। ঘরের মাঠের ফল বাইরে ধরে রাখতে পারলেই প্রকৃত অর্থে বড় দলের স্বীকৃতি লাভ করবে বাংলাদেশ।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সদ্য-সমাপ্ত টেস্ট সিরিজ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি অনেক, তবে আশঙ্কার জায়গাও কম নয়। সিরিজে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন দুই ম্যাচেই প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট তুলে নিতে পারার সক্ষমতা। নিজেদের কন্ডিশন কাজে লাগানো ও মনের মতো পিচ বানিয়ে সে সুযোগকে ব্যবহার করা। এ সিরিজ দিয়েই অভিষেক হয়েছে তিন নতুন ক্রিকেটারের, যার মধ্যে মেহেদি হাসান মিরাজের কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। এই তরুণ বলতে একাই ধসিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডকে। তিনি নিয়েছেন ১৯ উইকেট, যা ইংল্যান্ডের মোট উইকেটের প্রায় অর্ধেক। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দিয়ে আগে থেকেই তারকা হয়ে ওঠা সাব্বিরও টেস্টে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এ সিরিজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি মুশফিকের ক্যাপ্টেন্সির ইতিবাচক পরিবর্তন। পরিচিত রক্ষণাত্মক কৌশল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন তিনি। সেইসঙ্গে ভয়ের জায়গাও কম নয়। ভালো শুরুর পরও তাসের ঘরের মতো ধসে পড়া। ঢাকা টেস্টের প্রথম ইনিংসে শেষ ৩০ রানে বাংলাদেশ হারিয়েছে আট উইকেট। দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সিনিয়র ব্যাটসম্যানদের দায়িত্বহীনভাবে উইকেট ছুড়ে আসা; উইকেটে থিতু হয়েও ইনিংস লম্বা করতে না পারা; অতিরিক্ত স্পিন-নির্ভরতা। সামনের দিনগুলোতে ভালো করতে হলে এসব ভুল শুধরে নিতে হবে দ্রুত। বড় ম্যাচে এ ধরনের ভুলের মাশুলও বড় হতে পারে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট তার প্রমাণ।

সব মিলিয়ে এ সিরিজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিশেষ করে ক্রিকেটের জনকদের তিন দিনেই হারিয়ে দেওয়া ক্রিকেটবিশ্বকে নতুন বার্তা দেবে। এই বাংলাদেশ কেবল ওয়ানডেতেই নয়, টেস্টেও এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে এতটুকুতেই আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। সামনে যেতে হবে বহুদূর। যাত্রাপথের সব রসদ এখন গুছিয়ে নেওয়ার সময়।

লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক