ট্রাম্পের জয়

হিলারি যে কারণে পিছিয়ে গেলেন

Looks like you've blocked notifications!

এ যেন রীতিমতো জাদুকরের জাদু। একজন জাদুকর যেমন মানুষকে মোহাবিষ্ট করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তেমনি যেন মার্কিন জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন। জাদুকর নানা রকম কারসাজি করেন। চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেন। হাত সাফাই করেন। নানা রকম অঙ্গভঙ্গি এবং রকমারি পোশাক পরে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে নিক্ষেপ করেন। সে রকম সমস্ত জনমত জরিপ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভবিষ্যদ্বাণী এবং গণকদের গণনা মিথ্যা প্রমাণ করে তিনি এই বিজয় অর্জন করলেন। এ বিজয়ের মাধ্যমে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন।

রিপাবলিকানরা বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদ পূরণের পর ক্ষমতায় এলেন। এই দীর্ঘ আট বছরে অবশ্য রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে তাদের প্রাধান্য বজায় রেখে চলছিলেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী হিলারি ক্লিনটন ২২৮ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৯০ ভোট পেয়ে নিশ্চিত বিজয়ের পথে এগিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যেই ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পরাজয় স্বীকার করে মার্কিন ঐতিহ্য অনুসারে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যদিও বহু দলীয় অবস্থান রয়েছে, কার্যত দুটো প্রধান দল রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করে আসছে। এই দুটো দল হচ্ছে- ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান পার্টি। এবারে রিপাবলিকান প্রার্থী ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাজনীতিতে তিনি নবাগত। একজন ধনকুবের এবং রিয়ালিটি টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর পরিচিতি ব্যাপক। আগে তিনি কোনো সিনেটর বা প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ছিলেন না। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি চূড়ান্ত মনোনয়ন লাভ করেন। বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ- টেক্সাস সিনেটর টেড ক্রজ, ওহিও গভর্নর জন কেশিক, ফ্লোরিডার সিনেটর মার্কো রুরিও এবং অন্য প্রার্থীদের তিনি পরাজিত করেন। দুষ্টু লোকেরা বলে তাঁর এ বিজয়ের পিছনে অর্থবিত্তই প্রধান অনুঘটক ছিল।

অপরদিকে ডেমোক্রেটিকদলের প্রার্থী ছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন প্রথম নারী প্রার্থী। বিগত ২৬ জুলাই তিনি চূড়ান্তভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির চূড়ান্ত মনোনয়ন লাভ করেন। তিনি ভারমন্ড সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং অন্য প্রার্থীদের পরাজিত করে প্রার্থিতা অর্জন করেন। তাঁর প্রার্থিতার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কার্যক্রম নিঃসন্দেহে কার্যকর ছিল। নারী হিসেবে মার্কিন প্রগতিশীল সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রাথমিকভাবে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।

কিন্তু অবশেষে ‘নারীত্বই’ তাঁর পরাজয়ের কারণ হলো কি না তা বিবেচ্য বিষয়। বিস্ময়ের ব্যাপার যে মার্কিন সমাজকে মুক্ত সমাজ বলা হলেও তারা সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী ব্যক্তিকে নিষ্কলুশ দেখতে চায়। প্রথমদিকে ট্রাম্পের নারী কেলেঙ্কারি তাঁর জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে হিলারির নারীত্ব হয়তো তার প্রতিপক্ষের বদনামকে ঢেকে দিয়েছে। জনমত সব জায়গায় সব রাষ্ট্রেই একটি সংবেদনশীল বিষয়, একটি সেন্টিমেন্ট একটি নিশ্চিত বিজয়কেও যে পরাজয়ে রূপান্তর করতে পারে ট্রাম্পের বিজয় তার একটি বড় প্রমাণ।  হিলারির অতি উচ্চ বিশ্বাস এবং  অতি উদার মার্কিন গণমাধ্যম তাঁকে অতি উচ্চ জনপ্রিয়তা দিলেও বাস্তবতার সাথে তার সঙ্গতি ছিল সামান্যই। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে একটি জনবিচ্ছন্নতা বা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল হয়তো।

মূলত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রার্থিতা, বক্তব্য ও আচরণের কারণে এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। তিনি যেহেতু একজন পেশাদার রাজনীতিবিদ নন এবং অতীতের কোনো অভিজ্ঞাই তার নেই, সেজন্য মার্কিন পরিশীলিত সমাজে তাঁকে নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তিনি আদৌ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার পদে আসীন হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি নন বলে মন্তব্য করা হয়। তিনি চরমপন্থী  এবং রক্ষণশীল বক্তব্য দিয়েও বিতর্কিত হন। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ ছিল তাহলো- ১. ফেডারেল ট্যাক্স ফাঁকি ২. নারী কেলেঙ্কারী ৩. অমার্জিত আচরণ ৪. অসাংবিধানিক কথা-বার্তা ৫. বাগাড়ম্বরতা। সবচেয়ে আলোড়িত এবং আলোচিত বক্তব্য যেটি তার দৃশ্যত জনমত বিপক্ষে যাওয়া এবং কার্যত অদৃশ্যভাবে বিজয়ের কারণ, সেটি হলো অভিবাসী বিরোধী কঠোর বক্তব্য। যেমন তিনি বলেছিলেন- ক. ম্যাক্সিকো-মার্কিন সীমান্তে তিনি দেয়াল তুলবেন খ. মুসলমানদের তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেবেন না গ. কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে তাঁর অযাচিত মন্তব্য ।

ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এমন সব মন্তব্য করেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির পরিপূরক নয়। যেমন রুশ ফেডারেশনের সাথে মৈত্রীর কথা বলা, ন্যাটোকে অকার্যকর এবং সিরিয়ায় অনুসৃত মার্কিন নীতির বিরোধিতা করা। আরো আছে অকূটনৈতিক ভাষায় মুসলমানদের প্রতি অন্যায্য মন্তব্য করা। প্রকাশ্যে হিন্দু মন্দিরে গিয়ে সমর্থন কামনা এবং ‘আমি হিন্দুদের ভালোবাসি’ এ কথা বলা। এই নির্বাচনে এ ধরনের মন্তব্য অভিবাসীদের বিশেষত ম্যাক্সিকো থেকে আগত লাখ লাখ মার্কিন নাগরিককে আহত করেছে। তার কারণ মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে একটি অভিবাসীদের দেশ।

যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসীদের ক্ষেত্রে চরমপন্থার কথা বললেন, তখন অপেক্ষাকৃত পুরোনো ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত প্রবীণ অভিবাসীরা খুশিই হলেন। যতই অভিবাসীরা, কৃষ্ণাঙ্গরা হিলারি সম্পর্কে উৎসাহ দেখিয়েছে, ততই উদ্বিগ্ন হয়েছে মার্কিন ঐতিহ্যবাহী শ্বেত নাগরিক সম্প্রদায়। পাশ্চাত্য ভদ্রতা অনুযায়ী মার্কিন এসব নাগরিকরা দৃশ্যত বিরোধিতাকে হয়তো সৌজন্যমূলক মনে করেনি। কিন্তু শেষ সময়ে  গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ এবং ক্রোধ ব্যালটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। এমন সব অঙ্গ রাজ্য রয়েছে যেখানে দৃশ্যত হিলারির পক্ষ ভারী ছিল, যেমন ফ্লোরিডা, ওহাইও এবং নর্থ ক্যারোলিনা। এসব রাজ্যে রিপাবলিকানদের অতীতে প্রাধান্য থাকলেও এবারে মনে হচ্ছিল সেখানে ডেমোক্রেটরা ভালো করবে। উল্লেখ্য, জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিভাজিত ভোটে গরিষ্ঠ নির্বাচক মণ্ডলীর ধারক ছিল এসব রাজ্য। আর মনে রাখার কথা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যগুলোতে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী গরিষ্ঠ ভোট পেলে সব ভোটই তাঁর খাতায় লেখা হয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাদুকরী বিজয় গোটা পৃথিবীকে অবাক করেছে। নির্বাচনের পূর্বদিনেও আঁচ করা যায়নি যে- রক্ষণশীল, শ্বেতকায় এবং প্রবীণ নাররিকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হারানোর ভয়ে ভিতরে ভিতরে এত ক্ষোভ জমা করে রেখেছিলেন। যখন এফবিআই নির্বাচনের পূর্বক্ষণে হিলারি ক্লিনটনের ইমেইল ফাঁস করে বেফাস কথা বলে তখনই বোঝা যাচ্ছিল একটি বিশেষ মহল হিলারি ক্লিনটনকে কুপোকাত করার জন্য ভিতরে ভিতরে সক্রিয় ছিল। সম্ভবত ঠেলায় পড়ে শেষমুহূর্তে ই-মেইল অভিযোগ প্রত্যাহার করলেও, সে ক্ষত মেরামত করা হিলারির জন্য সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের তিনদিন আগে আবারও এফবিআইয়ের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছিল যে নির্বাচনের দিন ‘আল-কায়েদা’ হামলা করতে পারে। দৃশ্যত মার্কিন নাগরিকদের ভয় দেখানোর জন্য এটি ছিল ক্লিনটনবিরোধী শিবিরের একটি উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা-প্রতারণা।

স্মরণ করা যেতে পারে যে সেবারে জুনিয়র বুশের সময়ও ‘আল-কায়েদার’ তরফ থেকে তথাকথিত ভিডিও টেপ প্রচার করে মার্কিন জনমতকে পক্ষে নিতে পেরেছিল রিপাবলিকানরা। আট বছরের দীর্ঘ সময় ধরে রিপাবলিকানরা ক্ষমতার বাইরে ছিল। তাদের নেতা-কর্মীরা নিশ্চয়ই শেষ মুহূর্তে ট্রাম্পের ওপর তাদের রাগ অভিমান ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শুধু দলীয় স্বার্থে এবং দলীয় বুঝে ট্রাম্পকে তাঁর ট্রাম্পকার্ড দিতে সাহায্য করেছিল। দেখা গেছে রিপাবলিকান শীর্ষ নেতারা প্রথম দিকে ট্রাম্পকে বর্জন করলেও অবশেষে ভোটটি ঠিক জায়গা মতোই দিয়েছে। আমাদের দেশে যেমন বিদ্রোহী প্রার্থী প্রাথমিকভাবে পাত্তা পেলেও অবশেষে দলের চাপ এবং নিজের মনের চাপে দলীয় প্রতীকেই ভোট দিয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটনা ঘটেছে তেমনই।

মার্কিন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতরের খবর যারা রাখে তারা ভালো করেই জানে জনমতের অদৃশ্যে একটি কায়েমী স্বার্থবাদ সেখানে জেঁকে আছে। তাদের হাতে মার্কিন অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং প্রচার মাধ্যম। এটা হচ্ছে ইসরায়েলি লবি। প্রচলিত ধারণাটি এ রকম যে ক্ষমতায় যেতে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা একটি অনতিক্রম্য শক্তি। হিলারি ক্লিনটন তার উদার পররাষ্ট্রনীতির কারণে তাদের আস্থা হারিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তীব্র ইসরায়েলি বিরোধিতার মুখে হিলারি ক্লিনটন অবশেষে ইরানের সাথে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে একটি কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করেছিলেন। সবাই খবর রাখে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করপোরেটইজম দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান আয়ের উৎস সমরাস্ত্র ব্যবসা।

সম্ভবত মিলিটারি কমপ্লেক্স করপোরেটইজম হিলারি অনুসৃত উদার  নীতির সহায়ক ছিল না। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার গৌরব ফিরিয়ে আনার যে স্লোগান দিয়েছেন, তা এই করপোরেটইজমকে উৎসাহিত করে থাকবে।

নির্বাচন পরবর্তী বিচার-বিশ্লেষণ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর পরই বৈশ্বিক শেয়ার বাজারে ধ্বস নামে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানানোর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৩৪টি শহরে বিক্ষোভ, ভাঙচুর এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ক্যালির্ফোনিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা প্রকাশিত হয়েছে। গোটা বিশ্বে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে প্রায় সব রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানালেও সংবাদ মাধ্যমে যে অনানুষ্ঠানিক মনোভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে তা সুখকর নয়। তারপরও মার্কিন জনগণের সদিচ্ছার প্রতি সম্মান জানাতে হবে। ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ও সফলতা নিয়ে আন্দাজ অনুমনের জন্য কমপক্ষে তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমরা আশা করব ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন জনগণ প্রত্যাশিত  সম্মান ও সমৃদ্ধি অর্জন করবে।

 

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।