আন্তর্জাতিক

ব্রেক্সিট কি আটকে যেতে পারে?

Looks like you've blocked notifications!

২৩ জুন ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত গণভোটের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে ব্রিটেনের জনগণ যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে ভোট দেয়। ব্রিটেনের জনগণের এই সিদ্ধান্তে এমন কি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।

ডেভিড ক্যামেরন যেহেতু ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে কাজ করেছিলেন সেহেতু তিনি পরাজয় মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন ক্যামেরুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টেরেসা মে। ব্রেক্সিটের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান ছিল ধুম্রজালে ঘেরা। তার এই কৌশলী অবস্থানের কারণে খুব সহজেই করায়ত্ত্ব করতে পারেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, তিনি গণভোটের ফলাফলকে বাস্তবায়ন করবেন এবং তিনি যে এ ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তা প্রমাণ করতে সৃষ্টি করেন একটি ব্রেক্সিট মন্ত্রণালয়ের, যার দায়িত্ব পান ডেভিড ডেভিস, যিনি মূলত ব্রেক্সিটের পক্ষে জোড়াল ভাবে কাজ করেন।

সেই সঙ্গে নিয়োগ দান করেন বরিস জনসনকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে। প্রাক্তন লন্ডন মেয়র বরিস ছিলেন ব্রেক্সিটের পক্ষের সবচেয়ে সেলিব্রেটি রাজনীতিবিদ। যিনি কি না ব্রিটেনকে ইউরোপ থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য চরম মিথ্যাচার, ভুল তথ্য, ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী এরকম বিভেদ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ববাসী এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কাছে প্রমাণ করে যে তিনি ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদে বদ্ধ পরিকর।

এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে টেরেসা মে কনজারভেটিভ পার্টি কনভেনশনে ঘোষণা করে যে, ২০১৭ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই তিনি ‘ইইউ’ থেকে বের হওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরুর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে লিসবন চুক্তির ৫০ নম্বর আর্টিকেলের আওতায় আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে জানাবেন যে ব্রিটেন ইউরোপ থেকে বের হয়ে আসতে চায়। আর এই ঘোষণার পর থেকে দুই বছর সময় পাবে ব্রিটেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদকে পূর্ণতা দিতে।

কিন্তু গত ৩ নভেম্বর ব্রেক্সিটের জন্য লিসবন ট্রিটির আর্টিকেল ৫০-এর মাধ্যমে ব্রিটেনকে ইউরোপ থেকে বের হয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষমতা সরকারের হাতেই ন্যস্ত, নাকি তার জন্য পার্লামেন্ট কর্তৃক আইন পাস করার প্রয়োজন আছে সেই বিষয়ে ব্রিটেনের সবার চেয়ে সিনিয়র তিন জাজের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ যে রায় প্রদান করেন তার সারাংশ হলো যেহেতু আর্টিকেল ৫০-এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করবে এবং যার ফলে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট কর্তৃক পাস করা আইনের বিলুপ্তি ঘটবে সেহেতু পার্লামেন্টে আইন করেই তা করতে হবে। অর্থাৎ সার্বোভৌম পার্লামেন্টের আইনকে বাতিল করতে হলে, পার্লামেন্টকেই সে বিষয়ে আইন পাস করতে হবে।

মূলত এই আইনি প্রক্রিয়াটি শুরু করেন ক্যাম্পেইনার, ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার ও ফিলানথ্রোপিস্ট জিনা মিলার ও লন্ডনের হেয়ার ড্রেসার ডেইর ডস সান্টোস, পিউপলস চ্যালেঞ্জ গ্রুপের সাথে একাত্ম হয়ে। এই জাজমেন্টের প্যারাগ্রাফ ১৩ তে এ বলা হয়েছে- ইউকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল ১৯৭২ সালের কমিউনিটিস অ্যাক্টের মাধ্যমে, তাই ইউকে-কে ইউরোপ থেকে বের হয়ে আসতে হলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক পাস করা আইনের মাধ্যমেই করতে হবে।

এই জাজমেন্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রিটেনের ব্রেক্সিটের পক্ষের ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে জুডিশিয়ারির ওপর। ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর আক্রমণ কাঁপিয়ে দেয় ব্রিটেনের জুডিশিয়ারিকে। ব্রিটেনের স্মরণকালের ইতিহাসে নিরপেক্ষ জুডিশিয়ারিকে এমন নগ্নভাবে কেউ আক্রমণ করেনি। এই নগ্ন আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বার কাউন্সিল অব ইংল্যান্ড ও ওয়েলস লিখিত অভিযোগ উত্থাপন করে সরকারের কাছে, এ ব্যাপারে দোষী গণমাধ্যমসমূহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। সরকার এর নিন্দা জানালেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেন, ইতিমধ্যে ঠিক হয়েছে আপিলের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ইং।

তবে এই রায়কে কোনোভাবেই বলা যায় না যে ব্রেক্সিটকে তা আটকে দেবে। এই রায়ের কারণে হয়তো বিলম্বিত হতে পারে ব্রেক্সিটের আনুষ্ঠানিক শুরুর প্রক্রিয়া।

যারা ইউরোপ থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে তাদের মতে এই রায় মূলত গণভোটে জনগণের মতামতকে আইনি বেড়াজালে ফেলে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া। তাদের মূল ভয় হলো যদি পার্লামেন্টে এমপিদের ভোট দিতে দেওয়া হয় এবং পার্লামেন্ট মেম্বার তাঁদের নির্বাচনী এলাকার ভোটের ধরন ধরে ভোট দেন তাহলে পার্লামেন্ট ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ভোট দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে গণভোটের রায় বাতিল হয়ে যেতে পারে। এখানে ব্রেক্সিটিয়ারদেও আরো ভয়ের কারণ গণভোটের ফলাফল পার্লামেন্টের ওপর আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে না বরং তা উপদেশমূলক। সে কারণে পার্লামেন্ট চাইলে আইনসিদ্ধ ভাবেই গণভোটের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। ব্রেক্সিটের বিরোধিতাকারীরা যে এই আইনি লড়াই ব্রেক্সিটের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই করছে, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

তবে, প্রশ্ন থাকছে তারা কতটুক সফল হবেন এ ব্যাপারে। ৫ ডিসেম্বরের শুনানির পর সুপ্রিম কোর্ট যদি এই রায় বহাল রাখেন সে ক্ষেত্রে নতুন টার্ন নিতে পারে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া। এমনকি আটকে যেতে পারে গণভোটের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটি কারণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকার পক্ষের পার্টিগুলো যেমন- লিবারেল ডেমোক্র্যাট, স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট, সিনফেইন ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ব্রেক্সিটের বিপক্ষে অবস্থান নেবেন। অন্যদিকে লেবারপার্টি লিডার যে শর্তগুলো আরোপ করেছেন তাতে থমকে যেতে পারে গণভোটের রায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। সেই ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মেকে হয়তো সহসাই জাতীয় নির্বাচনের ডাক দিতে হবে ব্রেক্সিটের পক্ষে পার্লামেন্টের নতুন ম্যানডেট নিতে। সেক্ষেত্রে বদলে যেতে পারে নতুন জাতীয় নির্বাচনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চিত্র। যদি প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে আবারও সরকার গঠনের পক্ষে রায় পান তাহলে ব্রেক্সিট থামানো হয়ে পড়বে দুস্কর। তবে লেবারপার্টি ও অন্যান্য দলগুলো যদি ব্রেক্সিটের বিপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে জয়লাভ করে সেক্ষেত্রে ব্রেক্সিটের প্রক্রিয়াটি থেমে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ইস্যুতে ব্রিটেনের জনগণ দ্বিধাবিভক্ত এবং ইস্যুটি অত্যন্ত সংবেদনশীল, বিশেষ করে যারা ব্রেক্সিটকে সাপোর্ট করে তারা মূলত ইমেগ্রেশন বিরোধী কট্টর ডানপন্থী, সেক্ষেত্রে ব্রিটেন পড়তে পারে স্মরণকালের ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটে।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।