ইতিহাস

তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ও স্বাধীনতার লড়াই

Looks like you've blocked notifications!

১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা। ইংরেজ বাহিনী ঘিরে ফেলে নারিকেলবেড়িয়া গ্রাম। এ গ্রামেই নির্মাণ করা হয়েছে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। রাতেই ইংরেজ বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। তাঁর নির্দেশে সেনাপতি মাসুম খাঁ একযোগে আক্রমণ পরিচালনা করেন। তীর-ধনুক, বর্শা, ইটের টুকরা আর কাঁচা বেলের আক্রমণে ইংরেজ বাহিনীর অনেকেই আহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরের দিনে ইংরেজ বাহিনীর দায়িত্বে থাকা কর্নেল একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এনে তিতুমীর বাহিনীকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানিয়ে কেল্লার প্রধান দরজায় তরবারি দিয়ে গেঁথে দেয়।

এতে তিতুমীর বাহিনীর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। কর্নেল তার নিজ বাহিনীতে ফিরে গিয়ে কেল্লা আক্রমণের নির্দেশ দেয়। বাহিনী কেল্লা তাক করে শুরু করে গুলিবর্ষণ। বন্দুকের মুহুর্মুহু গুলিতে অস্থির করে ফেলে কেল্লার বাসিন্দাদের। বেশ কিছু কামান তাক করে রাখা হয় কেল্লার দিকে। আত্মসমর্পণ না করলে এ কামান ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না ইংরেজ বাহিনী। কিন্তু এত কিছুর পরও আত্মসমর্পণ তো নয়ই, পাল্টা আক্রমণ করে তারাও। এই পাল্টা আক্রমণে আহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় ইংরেজ বাহিনী। এমন আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চলে বেশ কয়েক দিন। তিতুমীর এমন অসম যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন ধীরস্থিরভাবে। তারা আত্মসমর্পণ না করায় এই অসম যুদ্ধে একসময় কামান ব্যবহার করতে শুরু করে ইংরেজরা। ভেঙে পড়তে শুরু করে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। হঠাৎ একটি কামানের গোলা আঘাত করে তিতুমীরের ডান ঊরুতে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাঁর পা। ১৯ নভেম্বর এভাবেই লড়তে লড়তে স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দেন অকুতোভয় বীর তিতুমীর। ধ্বংস হয়ে যায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। এদিনে গ্রেপ্তার করা হয় তিতুমীরের সেনাপতি মাসুম খাঁসহ আট শতাধিক বীর যোদ্ধাকে।

তিতুমীরকে স্মরণ করে দিবসটি বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে পালিত হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাঁকে স্মরণ করেন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক হিসেবে। আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কৃষক সংগঠন তাঁকে মনে করে অত্যাচারী জমিদার এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক নেতা হিসেবে।

মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর ১৭৭২ সালে চব্বিশ পরগনা জেলার বাদারিয়া থানার হায়দারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কৃষকের ছেলে। তিতুমীর ছোটবেলা থেকে কৃষকদের ওপর জমিদার, নীলকর ও ইংরেজদের অত্যাচার করতে দেখেছেন। তরুণ বয়সে তিনি নিরীহ কৃষকদের রক্ষা করার শপথ নেন। নিজে শিখে নেন মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, তরবারি চালানো ইত্যাদি। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এক বিশাল বাহিনী।

ঠিক একই সময়ে, অর্থাৎ ১৮১৮ সালে দিল্লির উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ইতিহাসবিদরা এ আন্দোলনের নাম দেন ‘ওয়াহাবি আন্দোলন’। কিন্তু সৈয়দ আহম্মদ নিজে আন্দোলনকে বলেছেন ‘তরিকায়ে মুহাম্মদীয়া’। তিনি ১৮২১ সালে কলকাতা হয়ে হজের উদ্দেশ্যে মদিনায় যান। একই সময়ে হজব্রত পালন করতে মদিনায় যান তিতুমীরও। সেখানেই তাঁদের দুজনের দেখা হয়। সৈয়দ আহম্মদের পাণ্ডিত্য এবং সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন দেখে মুগ্ধ হন তিতুমীর। এ সময়ে তিতুমীর তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

দুই বছর মদিনায় থাকার পর দেশে ফিরে আসেন তিতুমীর। দেশে ফিরেই তিনি চব্বিশ পরগনা ও নদিয়া জেলায় জোরদার করেন ‘তরিকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলন। ১৮২৭ সালে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। তিতুমীরের উত্থানে ভীত হয়ে পড়ে জমিদাররা। স্থানীয় জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র দেব তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে বেশ কয়েকবার লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু লাঠিয়াল বাহিনী বারবারই পরাস্ত হয়ে ফিরে আসে।

এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র দেব। সে ‘দাঁড়ি’ রাখার ওপর কর বসিয়ে তা আদায় করতে শুরু করে। এতে রেগে গিয়ে ১৮৩০ সালের ৬ নভেম্বর প্রায় ৩০০ অনুসারী নিয়ে জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র দেবের বাড়ি পুঁড়া গ্রামে হামলা চালায় তিতুমীর। এতে উভয় পক্ষ ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এরপর তিতুমীর জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি ইংরেজদের খাজনা না দিয়ে তাঁর কাছে খাজনা পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ঘোষণা মানতে নারাজ জমিদাররা। গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় তিতুমীরকে কর দিতে সরাসরি অস্বীকার করে। তিতুমীর ও কালীপ্রসন্নের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কালীপ্রসন্নকে সাহায্য করতে তার বন্ধু লাটবাবু কলকাতা থেকে দুইশ হাবশি পাইক পাঠিয়ে দেয়। দুইশ লাঠিয়াল পাঠায় মোল্লাহাটি নীলকুঠির ম্যানেজার। কালীপ্রসন্নের নিজেরও ছিল চারশ পাইক, দুইশ লাঠিয়াল আর কয়েকটি হাতি। সবাই মিলে আক্রমণ করে তিতুমীরকে। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে তাদের তাড়িয়ে দেন তিতুমীর।

এ ঘটনার পর টনক নড়ে ইংরেজদের। বাংলার ছোটলাটের নির্দেশে কলকাতা থেকে সিপাহিদের একটি দল যশোরের বাগারি নিমক পোক্তানে যায়। সেখান থেকে একজন হাবিলদার, একজন জমাদার ও ২০ সিপাহি নিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে নারিকেলবেরিয়ায় অভিযান চালানো হয়। বশিরহাটের দারোগা রামলাল চক্রবর্তী তার দলবল নিয়ে অভিযানে যোগ দেন। এ সময় তিতুমীরের নির্দেশে তাঁর ভাগিনা গোলাম মাসুম পাঁচশ অনুসারী নিয়ে তাদের ঘিরে ফেলেন। তুমুল যুদ্ধ হয় এ সময়। ইংরেজ বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কোনো সুযোগই পায় না। অবস্থা বেগতিক দেখে ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় আলেকজান্ডার। আটক হয় দারোগা রামলাল। যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষের একজন জমাদার, ১০ সিপাহি ও তিন বরকন্দাজ নিহত হয়।

এ ঘটনার পর তিতুমীর ভারতের স্বাধীনতা দাবি করেন এবং নিজেকে স্বাধীন বাদশা বলে ঘোষণা করেন। মঈনুদ্দিন তাঁর প্রধানমন্ত্রী হন আর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নেন গোলাম মাসুম ওরফে মাসুম খাঁ। তিতুমীর বুঝতে পারেন, ইংরেজরা স্বাধীনতার এই ঘোষণা মেনে নেবে না কোনোভাবেই। তাই ইংরেজদের সঙ্গে তার সংঘাত অনিবার্য। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে নির্মাণ করেন ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা। এই কেল্লার সঙ্গে মিলিয়েই আজো স্মরণ করা হয় তিতুমীরের নাম।

 

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক।