জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

সর্ব উত্তরের এক অগ্রপথিক

Looks like you've blocked notifications!

একজন ভাষাসংগ্রামী, একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী নাকি একজন অনুপ্রেরণার বটবৃক্ষ। প্রতিটি শিরোনামই তো তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবু মন চায় নতুন কিছু। নিরন্তর ভাবনায় মনে পড়ে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি অভিভাষণ যাতে তিনি বলেছেন ‘বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাঁহাদের বাধ্যক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন।’ সব বিশেষণ ছাপিয়ে আমাদের নান্টু স্যার তাদেরই একজন। তাঁর রয়েছে সুদীর্ঘ ত্যাগ ও কর্মময় জীবন। দীর্ঘ যাত্রায় কুড়িগ্রামের ভাষাসংগ্রাম, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা ও স্কাউটস আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় জড়িয়ে নিজেই হয়ে উঠেছেন একজন অগ্রপথিক। এখনো চলছেন অবিশ্রান্ত। এ বয়সেও প্রতিদিন সামাজিক কাজকর্মে ছুটে যাচ্ছেন, সমাজ জাগরণে ভূমিকা রাখছেন তরুণোচিত তাঁর সক্রিয়তায়।

এ কে এম সামিউল হক নান্টু ১৯৪০ সালের ৩০ নভেম্বর নানাবাড়ি কুড়িগ্রাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি রাজশাহীর বদরগাছীতে। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সামিউল হক বড়। তাঁর বাবা কায়েম উদ্দিন আহমেদ পুলিশের পরিদর্শক ছিলেন। মা সালমা বেগম ছিলেন গৃহিণী। বাবার চাকরির সুবাদে কুড়িগ্রাম মহকুমায় বেড়ে ওঠেন তিনি।

মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় শুরু হয় মহান ভাষা আন্দোলন। সে সময়ের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার এ প্রতিষ্ঠানেও ভাষা আন্দোলনের ঢেউ লাগে। অন্য অগ্রজদের সঙ্গে তিনিও যোগ দেন ভাষা আন্দোলনে। মিছিল, সমাবেশ, শহীদ দিবসের কর্মসূচি থেকে শুরু করে টানা চার বছরের চেষ্টায় ১৯৫৬ সালে গহওর পার্কে  কুড়িগ্রামের প্রথম যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়, তাতে অন্যদের সঙ্গে তাঁর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য।

১৯৫৭ সালে এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বদল করে কুড়িগ্রাম বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এ সময় কুড়িগ্রাম শহরে কলেজ না থাকায় কলেজ স্থাপনের দাবি জোরালো হয়। নিজে সরাসরি যুক্ত থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন। ছাত্রদের সম্মিলিত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালে মহকুমা প্রশাসক ছলিম উদ্দিন আহমেদ কুড়িগ্রামে কলেজ (বর্তমান কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ) স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে আবারও লেখাপড়া শুরু করেন এবং এ সময় কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন তিনি। যুক্ত হন ‘প্রভাতী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনায়।

একসময় বাবার ইচ্ছায় পুলিশে যোগ দিলেও ভালো না লাগায় একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে কুড়িগ্রামে চলে আসেন তিনি। সে সময় কুড়িগ্রাম রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। 

 ১৯৬৭ সালে তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয়। কুড়িগ্রাম মহকুমা জনসংযোগ কর্মকর্তা কবি আকাশ নূর মোহাম্মদ একদিন লেখালেখিতে সংশ্রব থাকা কয়েকজন তরুণকে মফস্বল সাংবাদিকতার তাগিদ দেন। তাঁর তাগিদে যে কয়েকজন সাংবাদিকতা শুরু করেন তাঁদের মধ্যে সামিউল হক একজন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের কুড়িগ্রাম মহকুমা সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে কুড়িগ্রাম মহকুমা সাংবাদিক সমিতি গঠিত হলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব নেন। তাঁর নেতৃত্বে শহরের সবুজপাড়ায় স্থাপিত হয় কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের কার্যালয়। মোনায়েম খানের সময়ে ‘কুড়িগ্রামে অনাহারে মৃত্যু’ শীর্ষক সংবাদ ইত্তেফাকে প্রকাশের ফলে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে আত্মগোপনে থাকেন কিছুদিন। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে অন্যদের মতো তাঁর ভূমিকাও ছিল অনন্য।

দেশ স্বাধীনের পর শিক্ষকতা-সাংবাদিকতার পাশাপাশি স্কাউটসে নিমগ্ন হন সামিউল হক। বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে স্কাউটস দলের কার্যক্রম দেখে অভিভূত হন। তাঁর নেতৃত্বে কুড়িগ্রামের স্কাউটস আন্দোলনের জয়জয়কার তখন। এমন সময় বাংলাদেশ স্কাউটসের চিঠি পেয়ে ১৯৭৩ সালে রিজওনাল ফিল্ট কমিশনার পদে চট্টগ্রাম বিভাগে যোগদান করেন তিনি। তিন বছর পর বদলি হয়ে খুলনায় টানা ১০ বছর কাটান। এরপর ঢাকায় বাংলাদেশ স্কাউটসের  যুগ্ম সচিব, উপসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। কর্মে ভরা স্কাউটস জীবনে তিনি জাপান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, পাকিস্থান, ভারত ও হংকং সফর করেন এবং  ফিলিপাইনে ম্যানেজমেন্ট কোর্স ও জাপানে প্রতিবন্ধী বিষয়ে বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তার মধ্যে উপকূল অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের পর পুনর্বাসনের জন্য রোপ্য ইলিশ, দীর্ঘ সেবা অ্যাওয়ার্ড, বার টু দি মেডেল অব মেরিট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। ২০০৯ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বঙ্গভবনে বাংলাদেশ স্কাউটসের সর্বোচ্চ পদক রৌপ্য ব্যাঘ্র পদক পরিয়ে দেন তাঁকে ।

কিন্তু এসব কীর্তি ও কৃতিত্বের বাইরেও একজন রয়েছেন : ব্যক্তিমানুষ সামিউল হক নান্টু। যে কুড়িগ্রামের আন্দোলন, সংগ্রাম ও সংগঠন তাঁর জীবনের প্রতিচ্ছায়া, সেই কুড়িগ্রামকে তিনি কী করে ভুলে যাবেন? তাই চাকরি শেষ করে আবার চলে আসেন তিনি। আবার অগ্রসর হলেন সেই পরিচিত পথে। একে একে জড়িয়ে যান নানা সামাজিক কর্মে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময় উচ্চকণ্ঠ তিনি।

সামিউল হক নান্টু স্যারই বলেছেন, একসময় এই শহরের আকাশ ছিল নক্ষত্রে ভরা। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, চিরায়ত সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গন ছিল দ্যুতিময়। ইত্যাকার কর্মে যাঁরা সহকর্মী ছিল সেই আবদুল হামিদ, আবদুল আহাদ, বাদল রুদ্র, বুদ্ধদেব সরখেল, এস এম শামসুল হক, তোফায়েল হোসেন প্রমুখ আলো জ্বালিয়ে একে একে বিদায় নিয়েছেন। সে হিসেবে আমরা ভাগ্যবান এ জন্য যে, নান্টু স্যার এখনো আমাদের মাঝে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু সামিউল হক নান্টু স্যারকে আমরা কী দিতে পেরেছি? বর্তমানে আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যে সময়ে সামিউল হক নান্টুর মতো মফস্বলের আলোর মশালগুলো থেকে যায় আঁধারেই! আত্মপ্রচারের কালে সমাজে অচিন তাঁরা। অথচ সমাজ জাগরণে মফস্বলের এসব মাটির মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া আজ সবচেয়ে জরুরি।

তবু এ কথা স্যারকে নিশ্চয়ই বলা যাবে, সুন্দরের এই তীর্থপথে আমরা আপনাকে পাথেয় মানি। ৭৭তম জন্মদিনে আপনি আমাদের প্রণতি গ্রহণ করুন, গ্রহণ করুন কৃতজ্ঞতা। আপনি তরুণ থাকুন, শতায়ু হোন! শুভ জন্মদিন।

লেখক : নিউজ রুম এডিটর, নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশন