স্বাধীন ভাবনা

বাংলাদেশে বামপন্থীদের অর্জন কতটুকু?

Looks like you've blocked notifications!

ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অর্থনীতি, বেকারত্ব, নারীর চাকরি ও ক্ষমতায়ন এবং আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হলে ক্ষমতায় যাওয়া দরকার। কারণ, একটা রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করা ছাড়া এসব দায়িত্ব পূরণ করা সম্ভব নয়। যেহেতু বাংলাদেশে এখনো বামপন্থীরা ক্ষমতায় যেতে পারেনি, সুতরাং সাধারণ জনগণের জন্য এই বিষয়গুলো পূরণ করার দায়িত্ব পালন করাও সম্ভব হয়নি।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের বাম আন্দোলনের দীর্ঘদিনের যে ইতিহাস, সেখান থেকে মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ গড়া জরুরি হয়ে পড়েছে। এই যে প্রত্যাশা, এটা যে প্রয়োজন এবং এটা যে করা সম্ভব, তা মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছি বলে আমার কাছে মনে হয়। এটি একটি বড় কাজ। বাংলাদেশের সামনে আরো কতগুলো কাজ আছে। যেমন—অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়, গণতন্ত্রের বিষয়, মানবিকতার বিষয়, সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়, মানুষের মর্যাদার বিষয়। বাম রাজনীতি আর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করা যে মানুষের জন্য জরুরি এবং এটা যে করা সম্ভব, আমার বিবেচনায় সেই ধারণা বাংলাদেশের বাম আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

আর সবচেয়ে ভালোভাবে বামেরা আরেকটা কাজ করতে পেরেছে, বাম রাজনীতির আদর্শ ও নিষ্ঠা দিয়ে মানুষকে অন্তত পক্ষে কিছুটা হলেও আশাবাদী করে তুলতে পেরেছে। তবে এত সবের পরও আমি মনে করি, মানুষের যে প্রত্যাশা বাম দলগুলোর প্রতি, তা হয়তো আমরা এখনো পূরণ করতে পারিনি। সেই আত্মসমালোচনা ব্যক্তিগতভাবে আমার আছে। সে ক্ষেত্রে যেমন আমরা অনেক সময় যখন কথাবার্তা বলি, দেশের মানুষ বলে, হ্যাঁ আপনাদের কথা ভালো, সবঠিক আছে, আমরা যারা সাধারণ জনগণ আছি, আমাদের কথা কেউ বলে না, আমাদের স্বার্থের কথা কেউ বলে না। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যেভাবে পরিচালিত হয়—প্রথমে যে নির্বাচনী পদ্ধতি তার মধ্য দিয়ে যাওয়া, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত হলে তার যে দায়দায়িত্ব পালন করা—এসব প্রচলিত ধারায়, এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় বাম রাজনীতির অভ্যস্ত হতে হবে। সেই জায়গায় মনে হয় বড় ত্রুটি রয়েছে, আমরা আন্দোলনে যে পর্যায়ে ভূমিকা পালন করি, নির্বাচনে আমাদের কিন্তু সে রকম ভূমিকা থাকে না। আমরা নির্বাচিত হতে পারছি না।

আমার কাছে মনে হয়, এইটার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা দরকার যে আমাদের ত্রুটি  কোথায়। যেখানে সাধারণ মানুষ আমাদের ভালো বলছে, কিন্তু আমাদের ভোট দিচ্ছে না কেন? নিশ্চয় আমাদের কোথাও ত্রুটির জায়গা রয়ে গেছে। সব আমরা অর্জন করতে পেরেছি এমন নয়। সুতরাং সেটা আমাদের খুঁজে বের করে, আমাদের এই ত্রুটি কাটিয়ে উঠে যদি আমরা রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারি, তখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা, সেই  প্রত্যাশাগুলো আমরা পূরণ করতে পারব।

রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা, বাম রাজনীতি পুরোপুরি  সবকিছু পূরণ করতে পারেনি। হ্যাঁ, অনেক সময় আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, ব্যর্থতাও আছে। এত সবের পরও মানুষকে সচেতন করার কাজ, ঐক্যবদ্ধ করার কাজ, ন্যায্যতা নিয়ে লড়াইয়ের কাজ—এই কাজগুলো কিন্তু আমরা করতে পেরেছি। যেমন একটা উদাহরণ দিই, মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গড়ার কাজে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আমাদের একটা অনন্য অবদান ছিল। আশির দশকে আমাদের দেশের ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের যে জমির লড়াই, সেই লড়াইয়ে আমরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছি এবং তাঁদের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ করেছি। আমাদের দেশের কৃষকদের যে  দাবি, সেই লড়াই স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের পরও আমরা কিন্তু তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছি।

শ্রমিকদের যে লড়াই এখন চলছে, দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের ন্যায্য মজুরির আন্দোলন, সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বামপন্থীরা লড়াই করছে। আজকে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, সেই জায়গায় আমি মনে করি বামপন্থীদের ভূমিকা অনন্য। আর অনেক বড় ব্যাপার হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন, মুক্তবুদ্ধি চর্চার আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এসব ক্ষেত্রে যতটুকু বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে সবই কমিউনিস্টদের অগ্রণী ভূমিকার কারণে। এই কাজগুলোই আমরা করতে পেরেছি। আমার মনে হয়, বামপন্থীরা আরেকটা বড় কাজ করতে পেরেছে, যখন আমাদের দেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার ও যখন দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার দরকার, বামপন্থীরা বিভিন্ন সময়ে করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়।

লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, সিপিবি।