বিজয়

প্রথম জেলা হিসেবে শত্রুমুক্ত হয় যশোর

Looks like you've blocked notifications!

একাত্তরে নানা রকম সামরিক কৌশলগত কারণে পাক হানাদারদের কাছে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণ এই যে, সে সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তর ছিল কলকাতায়, যা যশোর শহর থেকে মাত্র ১১০ কিলোমিটার দূরে। তা ছাড়া এ অঞ্চলের একমাত্র বিমানঘাঁটিও ছিল যশোরে। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে হানাদাররা যে পরিমাণ শক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছিল, তার একটি বড় অংশই মোতায়েন ছিল যশোরে। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এ এলাকাকে এতটাই দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত করে যে, সে সময় পাকিস্তানিরা যশোরকে ‘প্রাচ্যের স্টালিনগ্রাড’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গর্ব করত। একই কারণে মিত্র বাহিনীর কাছেও যশোর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধকালে এ এলাকা ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে।

প্রথমে কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর ও খুলনার দৌলতপুর থেকে সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত ৮ নম্বর সেক্টরের এলাকা ছিল। পরে এলাকা কিছুটা কমিয়ে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা সদর, সাতক্ষীরা মহকুমা ও ফরিদপুরের উত্তরাংশ নির্ধারণ করা হয়। এ সেক্টরকে আবার সাতটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ৩০ মার্চ ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিনের নেতৃত্বে যশোর সেনানিবাসের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। চুয়াডাঙ্গার ইপিআরের উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীও বিদ্রোহ করেন। ১৯৭১-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনিই ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরে দায়িত্ব পান মেজর মঞ্জুর।

যশোরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন। যুদ্ধের শেষ দিকে এই ডিভিশনের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল আনসারী। এই ডিভিশনের অধীনে থাকা ১০৭ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের ২২ এফএফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) ঝিকরগাছা-বেনাপোল, ৩৮ এফএফ আফরা-সাজিয়ালি-আশানগর, ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যশোর-কলারোয়া-সাতক্ষীরা এবং ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যশোরে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। এই বাহিনীর ধারণা ছিল, মুক্তি ও মিত্রবাহিনী কলকাতা থেকে বেনাপোল-যশোর হয়ে, অথবা কৃষ্ণনগর-দর্শনা-চুয়াডাঙ্গা কিংবা মুর্শিদাবাদ-রাজাপুর-কুষ্টিয়া হয়ে তাদের ওপর চূড়ান্ত হামলা করতে পারে। সেই ধারণা থেকেই এই তিনটি রেখা বরাবর দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিল তারা।

কিন্তু হানাদারদের সম্পূর্ণ বোকা বানিয়ে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী বয়রা সাব-সেক্টর হয়ে কপোতাক্ষ নদ অতিক্রম করে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে গরীবপুরে পৌঁছে যায়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ছিল মিত্রবাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তাদের সঙ্গে গরীবপুরে পৌঁছে যায় পিটি-৭৬ ট্যাংক। ২০ নভেম্বর সন্ধ্যার মধ্যেই গরীবপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা লাইন গড়ে তোলেন তাঁরা।

যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও গরীবপুরের মাঝে ছিল বিশাল একটি বিল। ওই বিলই মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্টকে রক্ষা করেছিল বলে ভেবেছিল হানাদাররা। কিন্তু ১৯ নভেম্বর তারা গরীবপুরে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অবস্থান নেওয়ার কথা জানতে পেরে হতভম্ভ হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক মালিক হায়াত তাঁর বাহিনীকে অবিলম্বে যৌথ বাহিনীর ওপর হামলার নির্দেশ দেন।

২০ নভেম্বর ছিল ঈদের দিন। সকালে সবাই যখন ঈদের নামাজের জন্য তৈরি হচ্ছে, ঠিক তখনই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ২০-২৫টি গাড়ি ঢোকে চৌগাছার জগন্নাথপুর (বর্তমান নাম মুক্তিনগর) গ্রামে। গুলি করে হত্যা করে ৩০ জন নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষকে। বাড়ির পর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে থাকে। সংসদ সদস্য মশিউর রহমানের ভাই আতিয়ার রহমানসহ আরো দুজনকে ধরে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। জনশূন্য হয়ে পড়ে গ্রামের পর গ্রাম। তারপরও কেউ কেউ ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন। সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদেরও অন্যত্র চলে যেতে অনুরোধ করে বলেন, রাতে আরো বড় ধরনের যুদ্ধ হবে।

২১ নভেম্বর। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের এক সকাল। হঠাৎই গোলাগুলির শব্দে কেঁপে ওঠে জনমানবশূন্য নিস্তব্ধ জগন্নাথপুর গ্রাম। শুরু হয় ভয়ংকর এক যুদ্ধ। মেশিনগান, কামান, ট্যাংক, বিমান ব্যবহৃত হয় এ যুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি বা মল্লযুদ্ধও হয়। পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢোকামাত্রই তাদের সাতটি ট্যাংক ধ্বংস করে দেয় মিত্রবাহিনী। একপর্যায়ে হানাদার বাহিনীর দুটি বিমান তাদের সৈন্যদের সাহায্য করতে গেলে মিত্রবাহিনী একটি বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করে। আরেকটি বিমান যশোর ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়। ২২ নভেম্বর আবারও বিমান হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। মিত্রবাহিনীও পাল্টা বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের তিনটি স্যাবর-জেট জঙ্গি বিমান ভূপাতিত করে। ধ্বংস করে আরো সাতটি ট্যাংক ও বহু সাঁজোয়া গাড়ি। দীর্ঘ সময় ধরে এ যুদ্ধ চলায় একপর্যায়ে দুই পক্ষের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। তখন শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। এ যুদ্ধে দুই পক্ষের সহস্রাধিক সেনা মারা যান। একপর্যায়ে পিছু হটতে শুরু করে হানাদাররা।

৬ ডিসেম্বর সকালে ও দুপুরে পাকিস্তানের নবম ডিভিশনের সঙ্গে ভারতীয় নবম পদাতিক ও চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রচণ্ড লড়াই হয়। বিকেলের মধ্যে পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা বুঝে যান, যশোর দুর্গ আর কোনোভাবেই রক্ষা করা যাচ্ছে না। লেফটেনেন্ট কর্নেল শামস নিজের ব্রিগেড নিয়ে রাতের আঁধারে গোপনে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনার দিকে পালিয়ে যান। আর এভাবেই পতন ঘটে ‘প্রাচ্যের স্টালিনগ্রাডের’।

পরদিন ৭ ডিসেম্বর সকালে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে যায়। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ করার মতো আর একজন পাকিস্তানি সেনাও তখন ক্যান্টনমেন্টে ছিল না। সেখানে শুধু পড়ে ছিল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলা আর রসদ। টেবিলে প্লেটে প্লেটে সাজানো ছিল খাবার। পালানোর আগে পাকসেনারা সেগুলো খাওয়ার সময়ও পায়নি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যশোরে ঢল নামে মুক্তিকামী জনতার। দেশের প্রথম জেলা হিসেবে শত্রুমুক্ত হয় যশোর। (যশোর মুক্ত হওয়ার বিষয়টি টের পাওয়া যায় ৭ ডিসেম্বর সকালে, আসলে তার আগেই ৬ ডিসেম্বর রাতেই হানাদারমুক্ত হয়ে যায় যশোর)।

‘প্রাচ্যের স্টালিনগ্রাডে’র পতন হওয়ার পরই পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এই দুর্গের পতনের পরই পূর্বাঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ নিয়াজির অভিমত উদ্ধৃত করে এক বার্তায় বলা হয়, ‘যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় আসন্ন ...। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া না গেলে জীবনরক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়।’

পাকিস্তানি সেনাদের যশোর দুর্গের পতন-পরবর্তী সময়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকার পতন ত্বরান্বিত হয়। প্রতিবছর ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর নাইনথ ডিভিশন (বর্তমান নাম পাইন ডিভিশন) যশোর ডে হিসেবে পালন করে থাকে।

লেখক : যশোর প্রতিনিধি