স্বাধীন ভাবনা

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে তারপরও আশাবাদী

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই রাজনীতিতে ছাত্রদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। ছাত্র আন্দোলনের বিরাট একটা ভূমিকা ছিল। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ছাত্ররা অবশ্যই ভূমিকা পালন করছে। শুধু সেই ভূমিকাটা অনেক ক্ষেত্রেই আগের যে রাজনীতি, তা থেকে অনেক ক্ষেত্রে ম্লান মনে হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রগতিশীল সংগঠনগুলো তাদের সেই ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী। যেমনটা আমরাও করছি।

দীর্ঘ ১০ বছরের সামরিক শাসনের যে আন্দোলন, সেই আন্দোলন এ দেশের শিক্ষার্থীরা দেখেছিল। ছাত্রসমাজের ১০ দফা দাবি ছিল সে সময় এবং এরশাদ পতনের মধ্য দিয়ে সকলের ভেতরে এ ধরনের একটা তাড়না কাজ করছিল এবং প্রত্যাশা করছিল সবাই যে সম্ভবত একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালনা হবে। এই রকম একটা তাড়না সবাই অনুভব করছিল। কিন্তু আমরা সেটা পেলাম না। আমরা দেখলাম যে ’৯০-পরবর্তী সময়কালে প্রথমতই যেটা হলো সেটা হচ্ছে ছাত্র সংসদগুলো বন্ধ করে দিল। অথচ এটা ছিল ক্যাম্পাসের একটা প্রাণ। একটা বিশ্ববিদ্যালয় একটা শিক্ষাঙ্গন। গণতান্ত্রিক শাসন রহিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার এসে প্রথমেই যে কাজটা করল সেটা হচ্ছে ছাত্র সংসদ বন্ধ করে দিল।

কারণ ছাত্র সংসদগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ক্যাম্পাসগুলোতে চঞ্চলতামুখর রাজনৈতিক পরিবেশের একটা মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিল। ক্যাম্পাসগুলোতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সৃজনশীলতার যে বিকাশ এবং নেতৃত্বের যে গুণ সেটা কিন্তু ছাত্র সংসদের মধ্য দিয়েই এটা গড়ে উঠত। কিন্তু আমরা দেখলাম সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো যে একটা ক্যাম্পাস নির্জীব হতে থাকল। এখনো পর্যন্ত সেই ধারাটায় কিন্তু বহমান। আমি যেটা মনে করি এর মধ্যেও অনেক আন্দোলন কিন্তু বিভিন্ন ক্যাম্পাসে হয়েছে। ধরুন ২০ থেকে ২২ আগস্ট শামসুর নাহার হলের আন্দোলন ওই সময় একটা বিপ্লবী রূপ ধারণ করল। কিন্তু এর মধ্যেও জাহাঙ্গীনগরের আন্দোলন বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন বলেন, সেই আন্দোলন এক একটা মাইলফলক স্থাপন করেছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সমগ্র ক্যাম্পাসজুড়ে ছাত্র আন্দোলনের যেই ধারা সেই জায়গাতে ব্যাঘাত ঘটেছে। যেটার ফলস্বরূপ আমরা কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি ছাত্র আন্দোলনের প্রতি একধরনের অনীহা, ছাত্ররাজনীতির প্রতি একটা অনীহা তৈরি করা হয়েছে।

ছাত্ররাজনীতির বিশেষ করে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন যে যখন ক্ষমতায় আসছে কখনো ছাত্রদল, কখনো ছাত্রলীগ। যেহেতু এখানে ছাত্র সংসদ নেই। সেহেতু তারা এসে তাদের যে দখলদারিত্ব, ক্ষমতায় গিয়ে সেগুলোতে তারা ক্রাইম করার চেষ্টা করেছে। এতে গণতান্ত্রিক যে পরিবেশ সেটা প্রত্যেকটা সরকারের আমলে কিন্তু রোহিত হয়েছে। যেটার কারণে একটা বড় ভুক্তভোগী  আমরা। কিন্তু এরপরও ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছে। কিন্তু বিছিন্নভাবে অনেক আন্দোলন গড়ে উঠলেও সত্যিকার অর্থে ছাত্র আন্দোলন বলতে যা বোঝায় সারা দেশের ছাত্রজনতার যে ঐক্যের কথা আমরা বুঝি, সেটার তো একটা ঘাটতি আছেই। সেটার একটা বড় কারণ কিন্তু এই ছাত্র সংসদ নির্বাচনটাকে রোধ করে দেওয়া।

মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা ছাত্র ইউনিয়ন কিন্তু একটা শপথ নিয়ে ছিলাম। আমাদের একটি স্বপ্ন ছিল আমরা মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী সেই কাজগুলো করব। একাত্তরের পরবর্তী সময়কালে আমরা সারা বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে সৃজনশীল ধারার বিকাশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা দেখলাম পঁচাত্তরের পরে একটা পটপরিবর্তন হলো। এরপর আমরা দেখলাম দীর্ঘ সময় ধরে স্বৈরাচারের কবলে দেশ। সেটাকে নিয়ে আমরা সংগ্রাম করলাম। এরপর আমাদের চিন্তাধারাটা ছিল নব্বইয়ের পর এবার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে পারব। ছাত্র আন্দোলন নতুন ধারায় দিক ফিরে পাবে। কিন্তু তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো আসলে আমাদের নিরাশ শুধু করেনিই, আমাদের প্রত্যাখ্যাত করেছে। যারা আন্দোলনকারী ছিল, তাদের প্রতারিত করা হয়েছে। আমাদের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক দশ দফা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দেওয়া হয়েছিল। সেই দশ দফার কথা এখন মানুষ ভুলে গেছে। সেই দশ দফা এখনো প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেগুলো এখন ভুলে গেছে মানুষ।

ছাত্র সংসদ নির্বাচন ত্যাগের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের ধারায় এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং আমরা তারপরও আশাবাদী। কারণ এই ছাত্রসমাজের নেতৃত্বেই আমরা গণজাগরণের মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে বড় আকারে যুক্ত ছিলাম। বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি, আমাদের সামর্থ্যের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই আমরা মনে করি, যতটুকু এগিয়েছে আরো অনেক দূর এগোতে পারত ছাত্ররাজনীতিতে। ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে নীতিবাচক ধারণা তৈরি হতো না, ক্ষমতাসীন যারা আছে তারা যদি ছাত্রসমাজকে প্রতারিত না করত।

আমরা কিন্তু তনু হত্যার পর সারা দেশের ছাত্র ইউনিয়ন তার সমগ্র শক্তি নিয়ে নেমেছিলাম। আমরা মাসব্যাপী লাগাতার আন্দোলন করেছি। আবার যখন আফসানা হত্যা হলো, তারপরও কিন্তু আমরা দেশব্যাপী আন্দোলন করেছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, রাজনীতির বিষয়গুলো এমনভাবে বিদ্যমান যে সমগ্র আন্দোলনগুলো পরবর্তীকালে আমরা ফলপ্রসূ হতে দেখছি না। তনু বলেন, আফসানা বলেন আরো অনেক কিছু বলা যাবে। এই ঘটনাগুলো ঘটছে। এর বাইরেও অনেকগুলো ইস্যু নিয়ে আমাদের মাঠে থাকতে হচ্ছে। গত বছরও পয়লা বৈশাখের দিন যে ঘটনা ঘটে, সেই সময় আমাদের যে ভূমিকা সেটা দেশব্যাপী সবাই দেখেছে। তারপর হামলা-মামলা-নির্যাতন উপেক্ষা করে আমরা কিন্তু আমাদের আন্দোলন পরিচালনা করেছি। এবং শুধু মাত্র শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণই না, আমরা জাতীয় ও সামজিক বিভিন্ন ইস্যুতে এখনো পর্যন্ত সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখছি। নাসিরনগরের ইস্যু বলেন, সাঁওতালদের কথা বলেন, রোহিঙ্গাদের ইস্যু বলেন আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু করার চেষ্টা করছি। এখনো আমরা সেই রাজপথে অবস্থান ব্যক্ত করছি, বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন সংগ্রাম করছি। এবং এর বাইরেও বিভিন্ন স্থানীয় ইস্যু।

স্থানীয় কোনো ধর্ষণের ঘটনা বলেন, নিপীড়নের ঘটনা বলেন, নির্যাতনের ঘটনা বলেন, হত্যার ঘটনা বলেন কিংবা স্থানীয় কোনো সংকটের কথা বলেন, সেগুলোতেও কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন তার ভূমিকা পালন করছে। এর বাইরে জাতীয় ইস্যু, যেমন কিছুদিন আগে, শিক্ষককে হত্যা করা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের আন্দোলনে। শিক্ষক হত্যা নিয়ে আমরা আন্দোলন করলাম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নিয়ে বিশাল আন্দোলন হলো, সেই আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন বিশাল একটা ভূমিকা রেখেছে। এর আগে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশনে’র যে আন্দোলন সেই আন্দোলনটাতেও তো ছাত্র ইউনিয়ন তার সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছে, সেই আন্দোলনটাকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। আমরা আমাদের মতো করে চেষ্টা করছি।

লেখক : সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন