অগ্নিবীণা

নজরুল আমাদের সংস্কৃতির খুঁটি

Looks like you've blocked notifications!
হামীম কামরুল হক

নজরুল আধুনিক নন, কবি হিসেবেও এ সময় আর গণ্য নন, কেবল তাঁর গানটাই যা, এ ছাড়া আর কিছু নেওয়ার নেই-এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শোনা যায়, কিছু ইঁচড়ে পাকা তরুণ এ ধরনের কথা বলেন এবং কিছু মাথামোটা সাহিত্যের অধ্যাপকদের মুখেও এসব শোনা যায়। এতে তাঁরা কী প্রমাণ করতে চান জানি না, তবে এতে তাঁদের মূর্খতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। অথচ বাঙালি মুসলমান কেবল নয়, সমগ্র বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতিতে নজরুলের ভূমিকা ও গুরুত্ব কোনোভাবেই কমা তো দূরের কথা, এখনো অটুট, কারণ বাঙালি সংস্কৃতি যদি বাঙালি সৃষ্টিশীলতার ছাদ হয়, তো নজরুল এরই একটি খুঁটি। অসম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সর্বধর্মসমন্বয় যা-ই বলি না কেন, নজরুল হলেন তার প্রকৃষ্ট ধারক। ‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব, তখন নজরুলের গান গাইব’ কথাটা সুভাষ বসুর মতো মানুষ বলেছিলেন, তাঁকে যখন জাতীয়ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, তখন নজরুলের বয়স কত আর। অসামান্য লেখক শিবরাম চক্রবর্তীর প্রিয় দুজন বাঙালি লেখকের একজন নজরুল, অন্যজন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে, বাংলা সাহিত্যের সর্বাধুনিক লেখক কমলকুমার মজুমদার কাজী নজরুল ইসলামকে কবি হিসেবে কি সংগীতকার হিসেবে বিশেষ ভক্তি করতেন। এমন আরো উদারহরণ দেওয়া যাবে, কিন্তু এ তিনজনের উদাহরণ দিতে হলো, কারণ এরা বাঙালির সাংস্কৃতিক জগতের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী মানুষদের তিনজন। আর রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে কী মনে করতেন, শরৎচন্দ্র কেমন করে তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন, সেসব তো কিংবদন্তি হয়ে আছে। নজরুলকে কেউ পড়ুক, না পড়ুক, মানুক, না মানুক, তিনি এভাবে প্রবাদপুরুষ হয়ে গেছেন। কেন তিনি এই স্তরে উন্নীত হলেন? তাঁর একটা কারণ অনেকেই জানলেও বলেন না যে, একসময় আধুনিক মনস্ক বাঙালি মুসলমানের গর্ব করার মতো ব্যক্তি, জ্ঞানচর্চার দিক দিয়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আর সৃজনশীলতার দিক দিয়ে নজরুল ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। বাঙালি মুসলমান কতটা অর্জন করতে পারে জ্ঞান ও ভাবুকতা ও সৃষ্টিশীলতার দিকে এঁরা দুজন ছিলেন, কী এখনো হয়ে আছেন, তার আদর্শ।

নজরুলের আধুনিকতা টি এস এলিয়ট বা ডাব্লু এইচ অডেনের আধুনিকতা দিয়ে মাপার তো কোনো দরকার নেই। জীবনানন্দের মতো কবি নজরুলকে নিয়ে তিনটির মতো প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং তিনি জীবনের প্রথম দিকে যাঁদের মাধ্যমে সবচেয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন নজরুল তাঁদেরই একজন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালকের’ প্রতিটি প্রায় পালকে নজরুলীয় উত্তাপ আছে। আজই পড়ুন না যদি হাতের কাছে থাকে ‘একদিন খুঁজেছিনু যারে’কবিতাটা। “আজ বুঝি ভুলে গেছ প্রিয়া! পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া/ একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর, ভুলে গেছ তুমি!/ এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি/ আর মোর বুকে বাজে শুধু খেদ, শুধু অবসাদ! মহুয়ার, ধুতুরার স্বাদ/ জীবনের পেয়ালার ফোঁটা ফোঁটা ধরি/ দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি! মসজিদ-সরাই-শরাব/ ফুরায় না তৃষা মোর, জুড়ায় না কলজের তাপ!’’ জীবনানন্দের নিজস্ব স্বর ‘অবসাদ’ এবং নজরুলীয় ‘খেদ’ কী করে কতটা মিশ্রিত/ ব্লেন্ডেড হয়েছে, এই কবিতা তার দৃষ্টান্ত।

আসলে নজরুলকে অস্বীকার করা মানে সাংস্কৃতির পরম্পরাকে অগ্রাহ্য করা। কবি মোহাম্মদ রফিক একবার বলেছিলেন, নজরুলের কবিতা যত না, তারচেয়ে মানুষ হিসেবে তাঁকে ভালোবাসি তাঁর সাহসের কারণে, তাঁর বেপরোয়া জীবনের কারণে। একবার কোনো এক ক্ষমতাবান লোক, নবাব বা কোনো এক ক্ষমতাবান ইংরেজ নজরুলকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন এবং বলেছিলেন ওতটার সময় আসতে, নজরুল বলেছিলেন, আমি তো আপনার সময়মতো দেখা করতে পারত না, আমি নবাবের ঘড়িতে চলি না, আমি চলি আমার নিজের ঘড়িতে, সেই ঘড়িতে যখন সময় হবে তখন আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতে পারে। এই কথা বলার সাহস সেকালের কেন, একালের কোনো লেখক-কবির কজনের আছে সেটা সন্দেহ। নজরুল সেই জার্মান প্রবাদটি জানতেন কি না, আমরা জানি না : “যে পণ্ডিত রাজার কাছে যান, সে দেশ ধ্বংসের দিকে যায়, আর যে রাজা পণ্ডিতের কাছে আসেন, সে দেশ উন্নতির দিকে যায়”। এই কথাটা কতখানি গভীরভাবে বাস্তব সেটি বলা বাহুল্য। এর মানে জ্ঞানের কাছেই ক্ষমতার আসার কথা, জ্ঞান কখনো ক্ষমতার কাছে যাবে না, গেলেই জ্ঞান ধ্বংসের দিকে যায়। কারণ জ্ঞানের কাছে ক্ষমতা তার দিকনির্দেশনা পায়, কিন্তু জ্ঞান যখন ক্ষমতার কাছে যায়, তখন নিজেই দিক হারিয়ে ফেলে। তারপর কী কী হয়, সেসব নিয়ে বলার কিছু নেই। ফলে নজরুলের কাছে আমরা যতটা তাঁর গান কবিতার জন্য ঋণী তাঁর স্বভাবের কাছে, তাঁর সাহসের কাছ থেকে, তাঁর উদ্দাম সৃষ্টিশীল মনের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু নিত্য পাওয়ার ও নেওয়ার আছে।

এক শিশুসাহিত্যে নজরুলের যে অবদান, তাঁর সেসব ছড়া ও গান একেবারে ছোটবেলা থেকে বাঙালির শিশুকিশোরদের যেভাবে মাতিয়ে দেয়, তার তো কোনো তুলনা চলে না। একজন শিশুর কল্পনশক্তির সেই বিকাশের ওপর নির্ভর করেই মূলত তার আগামীর পথে চলাটা সম্ভব হয়। এবং সে চলা ম্রিয়মান কোনো মানুষের চলা নয়, দীপ্ত অঙ্গীকারের পথ চল। নজরুল সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকেন তাঁর দায়বদ্ধতা এবং সৃজনশীল কল্পনার সঙ্গী হয়ে। সুভাষ বসু বলেছিলেন, যুদ্ধে যাওয়ার সময় নজরুলের গান গাইতে কিন্তু আমরা তো সেই সঙ্গে দেখি নজরুল কবিতা ও গান আমাদের প্রেম আনন্দ ও শান্তিরও সঙ্গী। কিন্তু কথা ভোলার কোনো সুযোগ নেই যে, নজরুলের এত আনন্দ, এ প্রেম, এত বিদ্রোহ তাঁর শেকড়ে আছে এক গভীর বেদনাবোধ। অতল দুঃখের সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে যে মানুষ নিত্য পাড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে, নজরুল সেই স্বপ্নের কাণ্ডারি কবি। হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া ব্যথা একটা অভিমুখ পায় নজরুলের কবিতা ও গানে। তারা নিরুদ্দেশে চলে না। হয়তো এই যে নির্দিষ্টতা, এই যে প্রত্যয়, এখানেও তিনি ‘আধুনিকতাবাদীদের’ চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু তিনিও তো মনে হয় পথের শেষ কোথায় জানতেন না। কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ তা জানে না। যে মানুষ তার নিজের জীবন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়, ‘কেরানি’ হয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। তবে কেরানি হওয়ার সুবিধা হলো, সাধারণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা। নিরাপদে থাকা। কিন্তু নিরাপত্তা তো কবির বা কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের প্রধান বিবেচনা হতে পারে না। তিনি নিত্য এক বিপন্ন মানুষ, জগতের সব সংকট তাঁকে ভোগায়, তাঁকে আর্তপীড়িত করে। আর সেই আর্তপীড়িত হওয়ার বোধ করার সময় যে যে কবি মানুষের পরম্পরা আমাদের সামনে আসেন, যাঁদের নামের সঙ্গে ‘মহান’ শব্দটি কেবল কোনো অভিধা হয়ে বিরাজ করে না, নজরুল সেই সব মহান কবি লেখকেরই একজন। এই সত্য কেউ স্বীকার করুন আর কেউ একে অগ্রাহ্য করুন, তাতে নজরুলের তাবৎ সৃষ্টি এতটুকুও টলে যায় না।

হামীম কামরুল হক : কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি