স্বাধীন ভাবনা

দেশকে আমি ভালোবাসি

Looks like you've blocked notifications!

মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে মুহিব হাবিলদার নামে এক ভদ্রলোক আমাকে ধর্ম মেয়ে বানান। তিনি আমাকে অস্ত্র দেখান। প্রথমে আমি অস্ত্র দেখি, অস্ত্র লুকিয়ে রাখি, অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেই। এভাবে বেশ কিছু দিন গেল। তারপর আমার সেই ধর্ম বাবা বলতেন, ‘তারামন তোমার অনেক সাহস হয়েছে। তুমি আরো কিছু কাজ করো।’ আমি বলি কী কাজ? আমি শিখব। তখন তিনি বললেন, ‘তারামন তুমি রাইফেল চালানো শেখো।’ মাঝে মাঝে বাবাই কিন্তু নদীর ধারে আমাকে নিয়ে গিয়ে রাইফেল চালানো শেখাতেন। আমি রাইফেল চালানো শিখতাম। যখন আমি রাইফেল চালাতাম, তখন আমার বুকে রাইফেলের বাড়ি খেতাম। পেছনে এসে ধাক্কা লাগত। সামনে দিয়ে গুলি বের হতো আর পেছনে ধাক্কা লাগত। তখন আমার বাবা বলতেন, ‘তারামন তুমি রাইফেল ছাড়ো। তুমি স্টেনগান চালানো শেখো।’ তারপর আমি স্টেনগান চালানো শিখেছিলাম।

আমার বাড়ি ও জন্মস্থান শংকর মাধবপুর, ইউনিয়ন কোদালকাটি। আমাদের শংকর মাধবপুর কোদালকাটি দিয়ে এসে পাক হানাদাররা ক্যাম্প করেছিল। গাড়ি করে আসত। আমার বাবা একদিন আমাকে বলছেন, ‘তারামন তুমি কি কিছু কাজ করতে পারবে?’ আমি বলি, কী কাজ? আমি করব। বাবা বলেন, ‘তোমার ইউনিয়নে তোমার এলাকায় পাক হানাদাররা এসে ক্যাম্প করছে, ওরা কোথায় কী করছে, তুমি কি পাগল বেশে খোঁজখবর এনে দিতে পারবে?’ আমি বলি, হ্যাঁ আমি পারব। তখন আমার বাবা বলেন, ‘তারামন আমি বললাম আর তুমি রাজি হয়ে গেলে? তুমি তো মারাও যেতে পারো।’ আমি বললাম যে আব্বা, আমি যদি মারাও যাই, তাহলে তো সবাই বলবে তারামন যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছে। আমি পারব।

রৌমারী রাজিতপুরের পেছনে যে নদীটা ওই নদীর উত্তর পাশে আমার বাড়ি ছিল। দশঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। ওই ক্যাম্প থেকে আমি সাঁতরে আমার বাড়িতে যেতাম। আমার মায়ের ছেঁড়া কাপড় পরে আমি পুরো পাগলী সেজে কোথায় পাক হানাদার আছে, কোথায় ওরা ক্যাম্প করছে, কোথায় ওরা এলএমজি ফিট করছে, মর্টার সেট করছে সব আমি জেনে নিতাম। আমি পাগল সেজে হাতড়াপাড়া যেতাম, হামুপাড়া, গোড়পাড়া যেতাম। একদম পাগলিনী সেজে আমি একদম পাক হানাদার ক্যাম্পে চলে যেতাম, ওরা কোথায় কী রাখছে, সব দেখতাম।

মুখ চুল দিয়ে ঢেকে রাখতাম। গায়ে গতরে কালি, গোবর মেখে রাখতাম। ওরা ধমকাত কথা বলার জন্য। আমি কথা বলি নাই কখনো। জোরে ধমক দিত, নাম জিজ্ঞেস করত, তখন আমি চুল উল্টে শুধু হাসতাম। তখন বুঝত যে ‘ছেরি পাগল’। পরে আবার কুকুরের মতো ছেই ছেই করে তাড়িয়ে দিত। আমি ওইভাবে আবার গোড়পাড়া চলে আসতাম। দেখতাম যে যখন পাক হানাদারদের ক্যাম্প আর দেখা যাচ্ছে না, তখন আমার বাড়িতে ফিরতাম। এরপর মায়ের সেই ছেঁড়া কাপড় রেখে, গা-গতর ধুয়ে সাঁতরে ফের আবার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে চলে আসতাম।

এসে পুরো রাত সব কিছু বলতাম। আমার সেই কথা শোনার পর মুক্তিযোদ্ধারা পদক্ষেপ নিতেন, কীভাবে পাক হানাদারদের ওপর আক্রমণ করবেন। আমি কিছুদিন ওইভাবে ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প যেখানে যেখানে যেত আমি তাদের সঙ্গে থাকতাম। সব সময় আমরা ঝুঁকির মধ্যেই থাকতাম। এভাবেই আমি সবার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জীবন বাজি রেখে।

বর্তমান সরকার তো মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়িয়েছে, অনেক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, আমি পাচ্ছি। আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলাম তা পূর্ণ হয়েছে। আলবদর-রাজাকাররা আমাদের মা-বোনের অনেকের মানহানি করেছে, নির্যাতন করেছে, তারপর বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, কোলের শিশুদের মেরে ফেলে রেখেছে। যখন ১৯৯৫ সালে আমি পদক পাই, তখনই কিন্তু আমি বলেছিলাম আমরা রাজাকারের বিচার দেখে যেতে চাই। এখন আমি সেই রাজাকারের বিচার দেখতে পাচ্ছি। বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি আজকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, আমি বিচার দেখে যেতে পারছি, আরো যারা বাকি আছে, তাদেরও বিচার করা হোক।

আমি খুবই অসুস্থ, হাঁটতে পারি না। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। একদম বিছানায়। যখন আমার কাশি ওঠে, তখন আমার হুঁশ থাকে না। তখন আমার কাছে মনে হয় পৃথিবী ছেড়ে যাওয়াটাই বেশি ভালো। আমি খুব কষ্টের মধ্যে আছি। আমার মাথাব্যথা, কোমর ব্যথা। কোমর থেকে পিঠ পর্যন্ত জ্বলে। যখন আমার কাশি আসে, তখন মনে হয় কোমর থেকে চেপে ধরে। তখন আমি চিৎকার দেই, আমার দম বোধহয় শেষ। আমি এভাবে কষ্টের মধ্যে আছি। কিন্তু তা ছাড়া আমি সব দিক দিয়ে সুখে আছি। আল্লাহ আমাকে সুখে রেখেছে সব দিক থেকে। আমার শারীরিক অবস্থাটা ভালো না বলে আমি কষ্টে আছি। দেশকে আমি ভালোবাসি, দেশের মানুষকে আমি ভালোবাসি, সরকারকে আমি ভালোবাসি।   

 

শ্রুতিলিখন : তানভীন আহমেদ ফাহাদ