স্বাধীন ভাবনা

আমরা এখনো ভুলিনি

Looks like you've blocked notifications!

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যেকটি ঘটনায় স্মরণীয়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলা রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের বহু ঘটনা আমার স্মৃতিতে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবে না। মার্চ মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলা প্রতিটি ঘটনায় ছিল নিষ্ঠুরতায় ভরা, পাশবিকতায় ভরা, হৃদয়বিদারক, বেদনাকাতর ও লোমহর্ষক।

এমনই একটি ঘটনা প্রায়ই খুব মনে পরে। নওয়াপাড়া শহিদ মিনারে একদিন তিনটি মানুষের মুণ্ডু ঝোলানো দেখেছিলাম। মাথাগুলো লোহার শিক দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, এরমধ্যে দুজন নারীর মাথা, একজন পুরুষের মাথা ছিল। সেদিন পিস্তলের আঘাত দিয়ে আমাকে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছিল রাজাকারের দল। এদের মধ্যে সাব্দুল্লাহ রাজাকার আমাকে বলে, এদের মতো তোকেও ওই অবস্থা করা হবে, আমাদের কথা না শুনলে। এটা অনেক মর্মদায়ক ঘটনা ছিল। ওই দিনের সেই ঘটনার পর প্রায় তিনদিন আমার সব স্নায়ু শিথিল হয়ে গিয়েছিল। আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না, সবকিছু যেন কেমন অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। সে দিনগুলো খুবই কষ্টে কেটেছিল আমার। এখনো মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। গা ছমছম করে ওঠে।

৭ মে আমাদের প্রতিবেশী ১৮ জনকে আমাদেরই চোখের সামনে যখন হত্যা করল, তখন আমি ৫০ গজ দূরে ছিলাম। এত কাছ থেকেই এই বর্বর দৃশ্য আমাকে দেখতে হয়েছিল। সেই ১৮ জনের সমাধি এখনো আছে। এই ঘটনাটি ঘটেছিল খালিশপুরে মুন্সি বাড়িতে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মুন্সি বাড়িটি এখনো আছে। ওদের অপরাধ, ওরা আওয়ামী লীগ করত। এজন্য একসঙ্গে ১৮ জনকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছিল হায়েনার দল। একই সময়ে আমাদেরও খুঁজেছিল, কিন্তু ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছিলাম পশুগুলো আমাদের দেখতে পায়নি।

আরেকটা ঘটনা খুব মনে পড়লে স্মৃতিকাতর করে তোলে আমাকে। এটিও লোমর্হষক ঘটনা, এখনো সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে অস্থির হয়ে উঠি। বেদনায় নীল হই, কষ্টে ভারাক্রান্ত হই। সেদিন আমাদের বাসার তিনতলা ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে দেখি বিহারি আর রাজাকাররা এক হয়ে মিলের লোকদেরকে পাট কাটা মেশিনে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ভৈরব নদীতে ফেলছে। এই দৃশ্য যে কী বেদনাদায়ক তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। নিশ্বাস ভারি হয়ে যায়, এই নির্মমভাবে হত্যা করা দেখে।

১৬ ডিসেম্বর যখন দেশ স্বাধীন হলো। তৎকালীন খুলনার রেডিও স্টেশনের সামনে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ঘাতকরা। সেখানে অনেক লাশ একটার পর একটা সাজানো। পাকিস্তানী আর্মি আর এ দেশের রাজাকাররা মিলে হত্যা করে এইভাবে লাশগুলো রেখে দিয়েছিল। এরপর পিছন দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই পিরামিডের মতো, একতলা বাড়ির সমান উঁচু শুধু লাশ আর লাশ। তখনো পুরোপুরি মানুষের মাথা, হাত, শরীর, কঙ্কাল হয়নি। কী যে করুণ সেই লাশগুলো। সেই দৃশ্যও আমি দেখেছিলাম। এটা একটা লোমহর্ষক ঘটনা। লাখ লাখ লোককে মেরে রেডিও স্টেশনের সামনে এবং লেকের দুই পাশে রেখে দিয়েছিল, নরপশু পাক আর্মি আর রাজাকাররা। আমরা সেসব ভুলিনি।        

 

শ্রুতিলিখন : তানভীন ফাহাদ