নার্গিস, মাসা ও ইরানের মানবাধিকার

Looks like you've blocked notifications!

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের প্রথম সারির একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আয়রন সাইড স্টেট স্কুল। এই স্কুলে আমার সন্তানের সহপাঠী একজন ইরানি শিশু। ফুটফুটে, মায়াবী চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত, সপ্রতিভ এই শিশুটি সহজেই সবার নজর কাড়ে। স্কুল শুরুর সময় ও শেষে এই শিশুটির পরিবারের সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠেছিল। শিশুটির বাবা-মা দুজনই শিক্ষকতা করতের তেহরানের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু কট্টর ইসলামী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সন্তানকে নতুন জীবন দিতে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে এই দম্পতির সাথে মাঝে মধ্যেই আলাপ হতো।

ইরানের সভ্যতা হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ। আমাদের সবারই জানা পূর্বে পারস্য নামে পরিচিত এই  ভূখণ্ডে এক সময় উন্নত সংস্কৃতির চর্চা হতো হয়তো এখনও হয়। আমি মনে করি শাসক যতই কঠোর হোক না কেনো সংস্কৃতি চর্চার ধারাকে রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। ইরানের মহাকবি ফেরদৌসির ‘শাহনামা’ মহাকাব্য বিশ্ব সাহিত্যের অপরিহার্য অংশ। এছাড়া বর্তমান যুগে ইরানের চলচ্চিত্রও বিশ্ব দরবারে মাঝে মধ্যেই আলোচনা তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ইরানি বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার মাজিদ মাজিদীর ‘চিলড্রেন অব হ্যাভেন (১৯৯৭)’, ‘কালার অব প্যারাডাই (১৯৯৯)’ ও সাম্প্রতিক সময়ে ‘মোহাম্মদ: দ্যা ম্যাসেঞ্জার অব দ্য গড (২০১৫)’ দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। এ বছরের এপ্রিল মাসে আমার সন্তানের সহপাঠীর মায়ের সাথে স্কুল চত্ত্বরে কথা হচ্ছিলো সাম্প্রতিক ইরান নিয়ে। তিনি জানিয়েছেন, ইরান বিশ^ সভ্যতার থেকে খুব পিছিয়ে নয়। ইরানের রাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার কাঠামোও বেশ শক্তিশালী। একইসাথে ইরান প্রযুক্তিগতভাবেও বেশ এগিয়ে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এরপর তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মাসা আমিনীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘিরে দেশটির সাম্প্রতিক আন্দোলন, জাগরণ ও হত্যাকা- সম্পর্কে। এ বিষয়ে তিনি আমার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেননি। কিন্তু মাসা আমিনীর মৃত্যু ও এরপরের আন্দোলনে বর্বর হত্যাকা-ে তিনি যে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ সেটা লুকাতে পারেননি। উল্লেখ্য, বিশে^র বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, মাসা আমিনী হত্যাকা-ের প্রতিবাদের সারাদেশের গণআন্দোলন দমাতে পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী।

মাসা আমিনীর হত্যাকা- ও পরের আন্দোলনে ইরানের কট্টর সরকারের ক্র্যাকডাউনে মুক্তমতের ইরানিরা যে কতোটা ক্ষুব্ধ তার একটা চিত্র আমার সামনে ফুটে উঠে কয়েকদিন পর। ঔই সময় একদিন পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম ব্রিজবেনের প্রাণকেন্দ্র কুইন স্ট্রিটে। চকচকে, জনাকীর্ণ, প্রাণবন্ত এই রাস্তাটি সময় কাটানো ও কেনা-কাটার জন্য খুব প্রিয় একটি জায়গা। এখানকার একটি আইকনিক স্থাপনা হলো ১৯৩০ সালে চালু হওয়া ‘ট্রেজারি বিল্ডিং’। অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শনে অভিজাত ভবন। এরপাশ দিয়ে যখন ফিরছিলাম, তখন একটা বড় ছবিতে চোখ পড়ে। নানা রংয়ে আঁকা অসাধারণ একটি ছবি। চিনতেও পারলাম। ছবিটি ইরানের সাম্প্রতিক অভূতপূর্ব বিপ্লবের আইকন ২২ বছর বয়স্ক কুর্দি তরুণী মাসা আমিনীর। ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর যাকে হত্যা করেছিল ইরানের নীতি পুলিশ। তাঁর মৃত্যু ইরানে বিপ্লবের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ছড়িয়েছিল। দেশটির জাতীয় পতাকার রংয়ে হালকা হাস্য উজ্জল ভঙ্গিতে ছবিটি আঁকা। আর গর্বের সাথে উড়ছে তাঁর এলোমেলো চুল। হিজাব দিয়ে যথাযথভাবে যে চুল না ঢাকার কারণেই নির্যাতনের পর এই তরুণীকে হত্যা করেছিল খোমিনির পুলিশ। ছবিতে মাশা আমিনির উড়ন্ত চুল বিশেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। আর ভাবলাম, অল্প বয়সী এই নারীর এলোমেলো চুল কতোটা গভীরভাবেই না নাড়িয়ে দিয়েছে ইরানের ক্ষমতার প্রাসাদ। আমিনীর এলো চুলের ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে ইরানসহ সারা বিশে^র শহর-বন্দর-গ্রামে। কুইন স্ট্রিটে মাশা আমিনীর পোটট্রেটের সাথে ছিল শ্লোগান সম্বলিত অনেক প্ল্যাকার্ড। ছিল মুক্তির ইশতেহার। এরপর সেখানে কথা হয়েছিল কয়েকজন সংগঠকের সাথে। তাদের মধ্যে অনত্যম ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী প্রবাসী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আজহার। তিনি দাবি করেন, আয়াতুল্লাহ খোমিনির আদর্শ ও কট্টর ইসলাম দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে  ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরান কট্টরপন্থি দেশে পরিণত হয়েছে। যদিও হাজার বছরের ইরান ও দেশটির মানুষ এতোটা কট্টর নন। তারা সংস্কৃতিবান, উদার, সহনশীল এবং ভীষণ রকম সৃষ্টিশীল। একইসাথে আত্মপ্রত্যয়ী ও প্রতিবাদী।

প্রত্যয়ী, প্রতিবাদী ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ইরানিদের প্রতিচিত্র আমার সামনে আবার ভেসে ওঠে ৬ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার বিকেলে। এ সময় নরওয়ের নোবেল কমিটি, ২০২৩ সালের শান্তি পুরস্কারের জন্য বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে ৫১ বছর বয়সী ইরানি মানবাধিকার কর্মী নার্গিস মোহাম্মদির নাম। ইরানের নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে যিনি এখনও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে বন্দি। এখনও পর্যন্ত তিনি, ১৩ বার গ্রেফতার হয়েছেন। বিচারে ৫ বার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। কারাদ- হয়েছে ৩১ বছরের। এছাড়া তাঁকে ১৫৪টি বেত্রাঘাতের দ-ও দেওয়া হয়েছে। ৫১ বছর বয়সী জীবনে ৩১ বছরের কারাদ-ের সাজা নিয়েও নার্গিস মোহাম্মদি ইরানের নারীদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অধিকারের কথা বলে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি ইরানের মানবাধিকার সংস্থা ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিরেন ইরানের আরেক বিশ^খ্যাত মানবাধিকার কর্মী নোবেল পুরস্তস্কার বিজয়ী শিরীন এবাদি।

এক সময়ের উদার, সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল, সংস্কৃতিবান ইরানের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি কি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটা উত্তরই পাওয়া যায়। কট্টর ইরানে মাসা আমিনীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজপথে নামা মানুষের সাথে এখনও বর্বর আচরণ করছে ইরানের রাষ্ট্রীয় বাহিনী। হাজার হাজার মানুষকে জেলে ভরা হয়েছে। কারাগারে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন হাজার হাজার প্রতিবাদী। যাদের অনেকেই নারী। যদিও তাদের এখনও দমন করা যায়নি। আর সেকারণেই বিশ্বের নানাপ্রান্তে নার্গিস মোহাম্মদির মতো অধিকার কর্মীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে হাজার হাজার, লাখ-লাখ মুক্তিকামী, সংবেদনশীল মানুষ উচ্চারণ করছেন সেই মন্ত্র- ‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’ ('Woman, life, liberty') । 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়