কুয়েতে সফল বাংলাদেশি আমেনা
সাধারণ একজন বাংলাদেশি হিসেবে ১৯৯০ সালে কুয়েতে গিয়েছিলেন আমেনা আক্তার রেনু। সেখানে খুব কষ্টে কাজ জোটেছিল। এরপর একটু-আধটু আরবি, ইংরেজি শিখে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। সেই আমেনা আক্তার রেনুই আজ কুয়েতে অনেক বাংলাদেশির কাছে আদর্শ। কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্য অর্জনের মডেল হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি।
কুয়েত যাওয়ার আগে
আমেনা আক্তার রেনু ১৯৭৩ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব থানার নব কলশ গ্রামের মোল্লা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রয়াত এম এ আওয়াল ও সুরজাহানের ছোট মেয়ে তিনি। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকায় বড় ভাই সিরাজুল ইসলামের বাসায় যান তিনি। ভাইয়ের বাসায় থাকা অবস্থাতেই পরিবারের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়। তাঁর স্বামী মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার দামলা গ্রামের মিয়া বাড়ির মরহুম আজহার মিয়ার ষষ্ঠ সন্তান এ কে এম আরিফ।
কুয়েতে জীবনসংগ্রাম
১৯৯০ সালের ১৭ জুলাই স্বামীর সঙ্গে কুয়েত প্রবাসীর খাতায় নাম লেখান আমেনা। শুরু হয় তাঁর জীবনযুদ্ধ। সেখানে অনেকের মতো গৃহিণী হয়ে থাকেননি, স্বামীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কাজে।
প্রথমে একটি ক্লিনিং কোম্পানিতে এক বছর কাজ করেন আমেনা আক্তার রেনু। পরে কেএফসিতে কুক সহকারী হিসেবে যোগ দেন। মিসরীয়, ভারতীয় ও ফিলিপিনোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করেন।
কেএফসিতে কাজ করতে গিয়ে একটু-আধটু আরবি শেখেন আমেনা। আর ইংরেজি কিছুটা বুঝতে পারলেও উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। ভাষাগত সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন বকুনি শোনেছেন দায়িত্বরত সুপারভাইজার ও ম্যানেজারদের কাছ থেকে।
আমেনা জানান, তিনজনের কাজ তিনি একাই করতেন। সহকর্মীরা দেখানো আদর করে বলত, ‘এটা করো ওটা করো।’ যখন সুপারভাইজার বা ম্যানেজার আসার সময় হয়, তখন তাঁকে আদর করিয়ে খেতে দিত সহকর্মীরা। ঠিক সেই সময়ে কর্মকর্তারা এসে দেখতেন তিনি (আমেনা) খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। আর তখনি শোনতে হতো বকুনি। কাঁদতে হতো নীরবে।
আমেনা জানান, একদিন তাঁর প্রতি সহমর্মিতা জাগে সহকর্মীদের একজনের। তাঁকে ডেকে বলেন, ‘তুমি কি কোম্পানির কাজের নিয়মকানুন জান না?’
বোর্ডে একটি তালিকা দেখিয়ে ওই সহকর্মী আমেনাকে বলেন, ‘ওই দেখ এখানে কার, কী কাজ সব স্পষ্ট করে লেখা আছে। তুমি প্রতিদিন এই রুটিন অনুসারে কাজ করবে। তোমার সহকর্মী অন্য কারো কথা শোনে নয়।’
সেদিন থেকে শুরু হয় আমেনার নতুন জীবন। কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় স্বল্প সময়ে কোম্পানির মালিক থেকে শুরু করে সুপারভাইজার, ম্যানেজার সবার কাছে পছন্দের কর্মী হয়ে ওঠেন। দুই বছর কাজ করার পর কোম্পানিতে স্থায়ী নিয়োগের সময় হলে আকামা পরিবর্তেনের সমস্যা হয়। এ কারণে ওই কোম্পানি নতুন করে ভিসা দেয়। সেই ভিসা নিয়ে কেএফসিতে যোগ দেন আমেনা।
ওই কোম্পানিতে এক মাত্র বাংলাদেশি নারী আমেনা, যাঁকে কোম্পানি ভিসা দিয়ে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময়ে কর্মজীবনে সততা, নিষ্ঠা আর কঠোর শ্রমের কারণে কোম্পানি কর্তৃক পেয়েছেন সম্মাননা। কোম্পানির সবার কাছে মামা আমিনা (মা আমিনা) নামে উপাধি পান।
বাঙালি হিসেবে প্রথমে ওই কোম্পানিতে অবহেলায় জীবন কাটলেও বর্তমানে বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি।
শুরু থেকে থেকে দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেছেন আমেনা। আস্থা অর্জন করেছেন। বর্তমানে দেরিতে আসা বা আগে যাওয়া নিয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোনো সমস্যা করে না।
অক্লান্ত পরিশ্রমী আমেনা বর্তমানে সকালে আরেক স্থানে পার্টটাইম কাজ করেন। একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানেও দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। এরপরও স্বামী, সন্তানদের নিয়ে ভালোভাবে সময় কাটানোর চেষ্টা করেন তিনি।
আমেনার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আহাদ তুর্জয় (২০) ও মেয়ে আফরিন রাশা (৯)।
কাজ ভালোবাসেন আমেনা
নিজেকে নারী ভেবে কখনো পিছু হটে যাননি আমেনা। কর্মস্থলে সততা আর পরিশ্রমের গুণে নিজের প্রচেষ্টায় সফল নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আমেনা বলেন, ঘরে বসে সময় নষ্ট করার চেয়ে কাজ করা ভালো।
আতিথেয়তায়ও এগিয়ে
ছুটির দিনে অবসর সময়ে কুয়েতপ্রবাসীদের আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন আমেনা। পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন মেলায় নিজ তৈরি পিঠা-পায়েস নিয়ে হাজির হন।
প্রবাস জীবনে আমেনার কয়েকজন বান্ধবী হয়েছে। মিনু, মমতাজ, সালমা, ইতি ও ডালিয়া নামের এ বান্ধবীদের সঙ্গে মিলে কোনো অনুষ্ঠানে একসঙ্গে দল বেঁধে চলেন। সুদূর প্রবাসে তাঁরাই অবসর সময়ের সঙ্গী। পরিবার সমাগম করা হবে এমন অনেক অনুষ্ঠানে বান্ধবী মহলে দলনেত্রী হিসেবে আমন্ত্রণ সবার আগেই থাকে। সামাজিকতায় সবার আগে থাকেন বলে অনেক সংগঠন থেকে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা।
স্বামীর কাছে যেমন আমেনা
আমেনার স্বামী আরিফ একটি কোম্পানিতে বড় দায়িত্বে চাকরি করছেন। তিনিও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করেন।
আরিফ জানান, জীবনযুদ্ধে প্রত্যেকটা কাজে তাঁর স্ত্রীকে পেয়েছেন। এমন স্ত্রী পেয়ে তিনি গর্বিত।