মানবকল্যাণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মানবকল্যাণের জন্য বারবার মানবশরীরে মর্ত্যধামে নেমে আসেন। ভগবানের এই নেমে আসাকেই বলা হয় ‘অবতার’। এভাবে অবতার হয়ে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিনী নক্ষত্রে গভীর রাতের আঁধারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন। গীতাতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্তা স্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তিকে) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।’ এ ছাড়া তিনি তাঁর জন্ম নিয়ে আরও বলেছেন, তাঁর জন্ম সাধারণ মানুষের মতো নয় এবং তাঁর মৃত্যুও সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়, কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া—দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।
অন্যান্য প্রাণী যেমন কর্মের ফলস্বরূপ জন্মগ্রহণ করে, ভগবান কিন্তু তেমনটি আবির্ভূত হন না। কর্মের ফলরূপে জন্ম হলে দুটি ব্যাপার থাকে—আয়ু ও সুখ বা দুঃখভোগ। ভগবানের এই দুটির কোনোটাই হয় না। কেননা তিনি হলেন আয়ু, সুখ ও দুঃখের ঊর্ধ্বে। অবতরণের সময় ভগবান নিজ শুদ্ধ প্রকৃতিরূপ শক্তিকে আশ্রয় করে অবতরণ করেন এবং অবতাররূপে এই শক্তি দিয়ে কাজ করেন।
শ্রীমদ্ভগবতগীতায় আছে—যখনই পৃথিবীতে অধর্মের প্রাদুর্ভাবে ভক্ত ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে দুরাচারীর অত্যাচার ও নিপীড়নে, তখন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য কৃপা করে ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর ‘অবতার’ রূপ নিয়ে থাকেন। তখন তিনি ষড়গুণ যথা ঐশ্বর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্য সম্পন্ন ‘পূর্ণাবতাররূপে’ প্রকাশ হন। ধর্মের মাত্রা যখন কমে যায়, অধর্মের মাত্রা যখন বৃদ্ধি পায়, মানুষ সত্যভ্রষ্ট হয়ে অসৎ পথে ধাবিত হয়; তখন স্বয়ং ভগবান মানবরূপে জন্মগ্রহণ করে অবতার হিসেবে আবির্ভূত হন। শ্রীগীতায় তাই স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সন-তারিখ পর্বটি নির্ভুলভাবে উল্লেখ করা দুরুহ ব্যাপার। পৌরাণিক শাস্ত্র অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়কাল যিশুখ্রিস্টের জন্মের ১০০০ বছর পূর্বের কথা। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৬০০ বছর পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল।
শ্রীমদ্ভগবতগীতায় জীবের মধ্যে সাম্যের শিক্ষা দিয়েছেন কৃষ্ণ। বর্তমানের বিভক্ত সমাজে গীতার উপদেশের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রীমদ্ভগবতগীতার পঞ্চদশ অধ্যায় কৃষ্ণ বলেন, এই সংসারে সমস্ত জীব আমার অংশ। তারা ছয় ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষ করছে। এতে মনও সম্মিলিত রয়েছে। কৃষ্ণ আরও স্পষ্টভাবে বলেন যে, নম্র পুরুষ নিজের বাস্তবিক জ্ঞানের কারণে সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখে। অর্থাৎ আমরা যখন কোনো ক্ষুধার্তের ক্ষুধা নিবারণ করি, তখন ঈশ্বরের ক্ষুধা মেটাই। প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে ঈশ্বর রয়েছেন। কোনো প্রাণীকে প্রতারিত করা, কষ্ট দেওয়া, ঈশ্বরকে কষ্ট দেওয়ার সমান। গীতার সাম্যের এই বাণী সর্বত্র পাওয়া যায়।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যখন মনুষ্য নিষ্কপট হিতৈষী, প্রিয় মিত্র, তটস্থ, মধ্যস্থ, ঈর্ষাবান, শত্রু ও বন্ধুকে সমান দৃষ্টিতে দেখে, তখন সে আরও উন্নত হয়ে যায়। আমাদের সাংসারিক সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, আমাদের ব্যবহারে সাম্য থাকা উচিত। আধুনিক যুগ সাম্যের বাণী প্রচার করে বলে বিশ্বের অন্যত্র মনে করা হয়। কিন্তু ভারতে শ্রীমদ্ভগবতগীতায় সাম্যের চিন্তাধারা অদ্ভুতভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে।
কোনো ধর্ম ভেদাভেদের অনুপ্রেরণা দেয় না। তা সত্ত্বেও আজকের শিক্ষিত সমাজে জাতিভেদ শীর্ষে রয়েছে। নানান সময় ব্যক্তি নিজের কুল, জাতি, ভাষা ও ধর্ম থেকে পৃথক অন্য ব্যক্তির প্রতি প্রতিকূল টিপ্পনি করেন। হিন্দু-মুসলাম, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, নিরামিষাশী-মাংসাশী, উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ, ভাষায় মধ্যে পৃথক পৃথক প্রতিযোগিতা চলে। ধর্মের নামে সমাজ বিভক্ত। এই ভেদাভেদ সমাজের কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। এই বিভেদের ফায়দা তোলে অনেকে। এই বিভক্তি আমাদের এমন একটি দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে, যার কারণে দেশে অনিবার্য আধ্যাত্মিকতার ঢেউয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।
আধ্যাত্মিকতার ঢেউয়ের অর্থ ঐক্যের অনুভূতি। এমন কিছু হওয়া উচিত, যাতে সকলে একে অপরকে এক অনুভব করে। অধ্যাত্মের প্রভাবে এমন হওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সমস্ত ধর্মের গন্তব্য স্থান একই। যে ভাবে নানান পথ থেকে প্রবাহিত হয়ে নদী সমুদ্রে পড়ে, সে ভাবেই মত-মতান্তর পরমাত্মার তরফে নিয়ে যায়।