জামালপুরের দৃষ্টিনন্দন মালঞ্চ জামে মসজিদ

ইসলাম শান্তি, সৌন্দর্য আর শৃঙ্খলার ধর্ম। মুসলিম উম্মাহ যুগে যুগে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নির্মাণ করেছে অসংখ্য মসজিদ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এসব মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়, অনেকগুলোই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন। তেমনই এক অপূর্ব সৃষ্টি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মালঞ্চ জামে মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন নকশা, সুউচ্চ মিনার আর আধ্যাত্মিক পরিবেশে ঘেরা এই মসজিদ এখন জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
জামালপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে মেলান্দহ উপজেলার মালঞ্চ এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদ যেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আত্মিক প্রশান্তির এক বাতিঘর। আধুনিক স্থাপত্যশৈলী আর ঐতিহ্যের সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদ স্থানীয় মানুষদের কাছে যেমন গর্বের, তেমনি ভিন জেলা থেকে আসা দর্শনার্থীদের কাছেও এক বিস্ময়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
প্রায় এক শতাব্দী আগে, ১৯৪০ সালে ধর্মপ্রাণ আব্দুল গফুর মন্ডল নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন এ মসজিদের ভিত্তি। সুরকি আর পাথরে তৈরি করা হয়েছিল তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি ছোট্ট মসজিদ। সময়ের আবর্তনে বদলেছে সবকিছু, কিন্তু বদলায়নি এই মসজিদকে ঘিরে মানুষের ভালোবাসা। ১৯৮৭ সালে আব্দুল গফুর মন্ডলের নাতি, দেশের খ্যাতনামা শিল্পপতি হাসান মাহমুদ রাজা পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদকে বর্ধিত করে সাত গম্বুজে রূপ দেন তিনি।
স্থাপত্যশৈলী ও বৈশিষ্ট্য
মসজিদটির নির্মাণশৈলীতে মোগল ও পারসিক স্থাপত্যরীতির স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। ১১ তলা বিশিষ্ট এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার মধ্যে সাত তলা মূল মসজিদ ভবন এবং চার তলা সুউচ্চ মিনার। বাহিরে এবং ভেতরে কারুকাজ করা হয়েছে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকরভাবে। বহিরাঙ্গনে নানা রঙের মূল্যবান টাইলসে খচিত দৃষ্টিনন্দন নকশা মসজিদটিকে দিয়েছে এক অপূর্ব বৈশিষ্ট্য।
চারপাশে সবুজ গাছ-গাছালিতে ঘেরা মনোরম পরিবেশ। সকাল-সন্ধ্যা দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এই অপূর্ব স্থাপত্যকর্মটি এক নজর দেখার জন্য। শুধু দর্শনার্থী নয়, অনেকেই এখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন।
মসজিদটির ইমাম নুর ইসলাম জানান, ‘মসজিদের মূল ভবনে একসঙ্গে ১২০০ থেকে ১৪০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে এবং দুই ঈদের জামাতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মুসল্লির সমাগম হয়। রমজান মাসে নিয়মিত ইফতারের আয়োজন করা হয় এখানে।’
মসজিদের খাদেম জয়নাল আবেদীন জানান, ‘আমি দীর্ঘ আট বছর ধরে এই মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত আছি। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে মানুষ আসে এই মসজিদ দেখতে। অনেকেই এসে নামাজ আদায় করেন। মসজিদটি এখন আমাদের এলাকার গর্ব।’
শিক্ষা ও সমাজসেবার বিস্তৃতি
মালঞ্চ জামে মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের স্থানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক সংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছে। মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি এতিমখানা, নূরানী ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর অসংখ্য শিশু-কিশোর কুরআনের হাফেজ হয়ে বের হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে মালঞ্চ কামিল মাদ্রাসা, যেখানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে শতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন আবাসিক ভবন।
এ ছাড়াও, মসজিদের পাশেই রয়েছে দাতব্য চিকিৎসালয়। গরীব, অসহায় এবং দুস্থ মানুষের জন্য সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় নিয়মিত। ফলে এই মসজিদ কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠাগুলো পুরো এলাকায় ইসলামী শিক্ষা, নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে অনন্য ভূমিকা রাখছে।
স্থানীয়রা বলেন, এই মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের প্রতীক। এমন দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা আমাদের এলাকার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণ।