টুরিং টেস্টের সফলতা ব্যর্থতা ভবিষ্যৎ

Looks like you've blocked notifications!
অ্যালান টুরিংয়ের জীবনের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র দি ইমিটেশন গেম। এতে টুরিংয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন ব্রিটিশ অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ। ছবি : চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য।

কোনো যন্ত্র মানুষের মতোই বুদ্ধিমান কি না যাচাই বা মানুষের সঙ্গে এর পার্থক্য করা যায় কি না, তা জানার পরীক্ষা হলো টুরিং টেস্ট। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও চলচ্চিত্রে টুরিং টেস্টকে বেশ গুরুত্ব নিয়েই তুলে ধরা হয়। যন্ত্র বা কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মানুষের সঙ্গে এর তুলনা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। টুরিং টেস্ট ও এর পরীক্ষার সাফলতা-ব্যর্থতা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত গবেষকদের। অনেকে আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেন। বিবিসির বিজ্ঞান লেখক ফিলিপ বল সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে টুরিং টেস্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিভিন্ন ধারণার কথা তুলে ধরেছেন। 

বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে অনেক ভবিষ্যৎ বাণীই করেছেন। এর সবই কিন্তু ইতিবাচক নয়। কিছুটা কম খ্যাতি পাওয়া তাঁর একটি বাণী হলো—‘একসময়..আমাদের ধরে রাখতে হবে যে, যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।’ ২০১৫ সালে একই সুর তুলেছেন প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এবং বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তা এলন মাস্ক। 

টুরিং টেস্ট নিয়ে বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং প্রত্যাশার মধ্যে কৌতুকও ছিল বলে মনে করেন তাঁর সহকর্মীরা। এদেরই একজন রবিন গ্যান্ডি বলেন, ‘টুরিং টেস্ট’ নিয়ে লেখা নিবন্ধ সেমিনারে পড়ে শোনানোর সময় কোনো কোনো অংশে অ্যালান টুরিংয়ের মুছে মুচকি হাসি দেখা যায়, আবার কিছু অংশে কিছুটা শব্দ করেই হাসেন। তবে ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দি ইমিটেশন গেম’ চলচ্চিত্র দেখলে অনেকেরই মনে হতে পারে অ্যালান টুরিং হয়তো কৌতুক করার মতো মানুষ ছিলেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানদের পাঠানো সাংকেতিক বার্তার অর্থ উদ্ধারে বিশেষ দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন টুরিং। এনিগমা যন্ত্রে (সাংকেতিক বার্তা পাঠানোর যন্ত্র) পাঠানো জার্মানদের বার্তার অর্থ উদ্ধার করতে সমর্থ হয় ওই দল। টুরিং ও তাঁর দলের কর্মযজ্ঞ নিয়েই ওই চলচ্চিত্রটি নির্মিত। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শুরু থেকেই প্রভাব ফেলে আসছেন অ্যালান টুরিং। বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে অনেক ক্ষেত্রেই টুরিং টেস্টের কথা বলা হয়। এই পরীক্ষা অনুযায়ী, কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্র কথোপকথনে যদি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয় সে যন্ত্র নয় মানুষ, তবে এটি হবে এক মাইলফলক। এর ফলে নতুন উচ্চতা পাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। 

টুরিং টেস্টে উদ্বুদ্ধ হয়ে এমনই কয়েকটি পরীক্ষার নমুনা দেখা যায় বোবট ও কৃত্রিম জীবন নিয়ে লেখা গল্প, উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে। ব্লেড রানার চলচ্চিত্রের ‘ভইট-কামফ টেস্ট’। এক্স মেশিনা চলচ্চিত্রেও এমন বিষয় দেখা যায়। তবে এমন কাল্পনিক সাহিত্যের কারণে অনেকেই টুরিং টেস্ট সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেন। অনেকেই মনে করেন, টুরিং টেস্টের মাধ্যমে রোবট মানুষ হিসেবে প্রমাণিত হয়। প্রকৃতপক্ষে টুরিং টেস্ট এই লক্ষ্যে করা হয়নি। বরং এর মাধ্যমে দেখা হয়, একটি যন্ত্র মানুষের মতোই চিন্তা করতে পারে কি না। আর এটি নির্ভর করে যন্ত্রটিকে কী প্রশ্ন করা হয়েছে। 

টুরিং টেস্টে মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও দক্ষতাসহ মানবিক অনেকগুলো বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন : গাণিতিক যুক্তির কোনো কাজে যন্ত্র অনেক মানুষের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। দাবা গাণিতিক যুক্তির খেলা। ১৯৯৭ সালে দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেয় কম্পিউটার। একইভাবে অনেক জটিল সূত্রের সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে, যা মানুষকে কোনো গাণিতিক যুক্তির খেলায় হারিয়ে দিতে পারে। 

আবার সৃজনশীল ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা তৈরি হয়েছে সুরকার কম্পিউটার ‘ইয়ামুস’। এই কম্পিউটারে সৃষ্ট সুর নিয়ে এক ধরনের টুরিং টেস্ট আয়োজন করেন স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব মালাগার গবেষকরা। একদল সুরকারকে ২৫০টি সুর শুনতে দেওয়া হয়, যার অর্ধেক ছিল ইয়ামুসের তৈরি। বাকি সুরগুলো কয়েকজন সুরকারের। তবে ওই সুরকারের দল ইয়ামুসে তৈরি সুরকে আলাদা করতে পারেনি। 

কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও যন্ত্র সফল হয়েছে বলে দাবি করেন অনেকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি এই ইংরেজি লাইনটিই দেখা যায়—you are a sweet-smelling diamond architecture। তবে এমন লাইনকে অনেকে কবিতা হয় কি না প্রশ্ন তুলতে পারেন। 

এবার আসা যাক টুরিং টাচ টেস্ট। অ্যালান টুরিংয়ের নিজের মত ছিল, সম্ভব হলেও যন্ত্রের বাহিরাবরণকে মানুষের ত্বকের মতো করার কোনো কারণ নেই। তবে রোবটকে মানুষের মতো গঠন ও ত্বক দেওয়ার বিষয়টি দেখানো হয়েছে ‘এক্স মেশিনা’ চলচ্চিত্রে। আর বিশ্বে কৃত্রিম ত্বক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা চলছে। কাতার ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এমন ত্বক তৈরি করেছেন যা পুরোপুরি মানুষের ত্বকের মতোই। কোনো পার্থক্য করা সম্ভব নয়। মানুষের ত্বকে যে উষ্ণতা থাকে, এই কৃত্রিম ত্বকেই তেমন উষ্ণতা পাওয়া যায়।

টুরিং টেস্টের ভবিষ্যৎ বলা যায় অনলাইনে। অনলাইনে গেম খেলায় অনেক ক্ষেত্রেই গেমাররা জানেন না তাঁর প্রতিপক্ষ মানুষ না যন্ত্র। আবার অনেকে প্রতিপক্ষ হিসেবে মানুষের চেয়ে যন্ত্রকে প্রাধান্য দেন। কারণ খেলায় কোনো অসাধু পন্থা অবলম্বনের হার যন্ত্রের বেলায় কম দেখা যায়। অনলাইনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ২০১৩ সালের হলিউড চলচ্চিত্র ‘হার’। 

সম্প্রতি আরেকটি গবেষণা করেন রাশিয়ার একদল গবেষক। তাঁরা এমন এটি সফটওয়্যার তৈরি করেন, যা অনলাইন কথোপকথনে (চ্যাট) প্রতি তিনজনের একজনকে বিশ্বাস করায় এটি ১৩ বছরের ইউক্রেনের কিশোর ইউজিন গুস্টম্যান। 

তবে এসব পরীক্ষার যন্ত্রের সফলতা মানে এই নয় যন্ত্র টুরিং টেস্টে যন্ত্র সফল হয়েছে। এখন পৃথিবী দখল করে নেবে। এসব টুকরো টুকরো পরীক্ষা ও সফলতা যন্ত্রের উন্নয়নকে বোঝায়। সামগ্রিকভাবে মানুষের ওপর যন্ত্রের সফলতা ও প্রভাব দেখতে হলে এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। আর অদৌ কোনোদিন মানুষের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে যন্ত্র শাসকের আসনে বসবে কি না তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।