যুক্তরাষ্ট্রে সফল বাংলাদেশি প্রযুক্তিবিদ আবু সুফিয়ান

Looks like you've blocked notifications!

‘বগুড়া জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। বিদ্যুতের কাজ, জুতা সেলাই, বই বাঁধাইসহ সব কাজ করতে পারি। বিজ্ঞান মেলা আমাকে আকর্ষণ করত। স্কুল শেষে দাঁড়িয়ে মুচির কাজ শিখতাম। বিজ্ঞান মেলায় আমি অনেক প্রোজেক্ট তৈরি করেছি। তখন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পদকও পেয়েছিলাম। দু-তিনবার জাতীয়ভাবে পদক পেয়েছি। একবার প্রেসিডেন্ট ও একবার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। সেভেন বা এইটে থাকা অবস্থায় ইলেকট্রিক্যালের প্রতি আগ্রহ জন্মে আমার। সেখান থেকে আজ প্রযুক্তিভিত্তিক ক্যারিয়ার গড়ে ভিনদেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি। তবে মনটা মাতৃভূমিতে পড়ে থাকে। তাই বিদেশে বসে দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করার চেষ্টা করছি।’ কথাগুলো এনটিভি অনলাইনকে বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আবু সুফিয়ান হায়দার।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তোলা আলফা ডটনেট ডট বিডির (alpha.net.bd) ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে আসেন আবু সুফিয়ান। এ সময়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। ভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে ইলেকট্রনিকসের ওপর অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি নেওয়ার পর ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন সুফিয়ান। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে গড়ে তোলেন আলফা নেট। এই কোম্পানি গঠনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির হোস্টিং সার্ভিস দেওয়া। গত ১৫ বছরে অনেক অন্তরায় সত্ত্বেও হাল না ছেড়ে ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তোলেন আলফা নেট। আলফা নেটের পাশাপাশি একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ প্রধান হিসেবে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের shopme.com নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া ফ্লোরিডায় বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত তিনি। মসজিদ ও কবরস্থান স্থাপনাসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে সব সময় এগিয়ে থাকেন আবু সুফিয়ান। এসবের পাশাপাশি মার্শাল আর্টেও আবু সুফিয়ান দীর্ঘদিন থেকে সম্পৃক্ত। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে রাইজিং সান মার্শাল আর্টস (rising-sun-dojo.com) নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। 

নিজের লেখাপড়া সম্পর্কে সুফিয়ান বলেন, ‘ইন্টারমিডিয়েটের পর ইলেকট্রনিকসের ওপর পড়ার জন্য দেশের কয়েক জায়গায় চেষ্টা করলাম। দেশের ভেতরে না পেরে শাহজালালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই, ১৯৯৪ সালে। একদিন ক্লাস করে ভারতে চলে যাই। এক বন্ধু ভারতে ইলেকট্রনিকসে পড়ে। বাসায় বলার পর ১১ দিনের মাথায় ভিসা-পাসপোর্ট নিয়ে বেনাপোল দিয়ে ভারত চলে যাই। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যাঙ্গালুরুর কাছে একটি কলেজে তিন বছরে অনার্স সম্পন্ন করি। এরপর আরেকটি ভারতীয় দর্শন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। 
 
কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে?

সুফিয়ান বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম। ভালো কিছু করতে হলে আমেরিকা যেতে হবে, এটাই ভেবেছি তখন। বন্ধুদের বলতাম, পড়াশোনা শেষে এক বছরের মধ্যে আমেরিকা যাব। এবং যাওয়ার এক বছরের মধ্যে একটি কোম্পানি খুলব। কোম্পানির মাধ্যমে আমেরিকা-বাংলাদেশের মধ্যে একটি কানেকশন তৈরি করব। ওখান থেকে বাংলাদেশের জন্য কীভাবে কাজ করা যায়, সেটা করব। আমেরিকা যেতে হলে কী করতে হয়, সেটা চিন্তায় ছিল না। ২০০০ সালে মাস্টার্স শেষ হলো। মাইক্রোসফট সার্টিফাইড সলিউশন ডিগ্রি নিই। সঙ্গে অ্যাপটেকের একটি ডিপ্লোমা করি।’
 নিজের সম্পর্কে সুফিয়ান আরো বলেন, ‘মাস্টার্সের শেষের দিকে ব্যাঙ্গালুরুর একটি সাইবার ক্যাফেতে বসি। এ সময় আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ই-মেইল এলো। আমি যদি পড়তে চাই, তাহলে আবেদন করতে পারি। বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা ফোরামে অংশ নেওয়ার কারণে হয়তো ওরা খবর পেয়ে মেইল করেছে। এটা আমি ক্লিয়ার না। ওই সময় আমি ভিজ্যুয়াল বেসিকের ওপর কাজ করি। কম্পিউটারের কোনো একটা বিষয়ের ওপর পরীক্ষা নেবে। যদি ভালো করি, তাহলে মাস্টার্স ফ্রিতে করাবে। ওই দিন কাজ ছিল। তার পরও আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিই। পরের দিন পরীক্ষা। ভিজ্যুয়াল বেসিকের ওপর পরীক্ষা দিলাম। ওরা ফোন নম্বর চাইল। কিন্তু আমার কোনো ফোন নম্বর ছিল না। ব্যাঙ্গালুরু থেকে ৩৬০ মাইল দূরের একটি বাসার ফোন নম্বর ছিল। যেখানে আমি থাকতাম। সারা রাত বাস জার্নি করে সেখানে গেলাম। পরের দিন ফোন করল। তারা ইংরেজি দক্ষতা দেখল। পরের দিন প্রস্তুতি নিতে বলল। ওখান থেকে সাত দিনের মধ্যে রিকোমেন্ডেশন লেটার পাঠাল। ভিসার জন্য আবেদন করলাম। ২০০১ সালে যাই। তখন আবার নাইন/ইলেভেন হলো। আবার আইটি ইন্ডাস্ট্রি ক্রাস করল। ওহাইওর একটি বিশ্ববিদ্যালয় বলল, এক সেমিস্টার পরে আসতে। তখন ফ্লোরিডায় আমার একজন কাজিন ছিল। তার সঙ্গে আলাপ করলাম। সে বলল, ভিসা যেহেতু হয়েছে, চলে আসো। পরে আমেরিকায় যাওয়ার পরে বলল, মাস্টার্স করা আছে, চাকরির জন্য আবেদন করো। তখন ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে স্থায়ী হয়ে গেলাম। ওহাইওতে আর গেলাম না। ২০০১-এর শেষের দিকে আলফা নেটের শুরু। আমেরিকায় কম্পিউটারের ওপর চাকরি বেশি। প্রফেশন হয়ে গেল হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেটওয়ার্কিং গ্রাফিকস ডিজাইন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, হার্ডওয়্যার ইত্যদি।’
 কর্মজীবন
যুক্তরাষ্ট্রে নিজের কর্মজীবন নিয়ে সুফিয়ান বলেন, ‘অরল্যান্ডোতে চাকরির সুযোগ পেলাম। দুই বছর কাজ করে অন্য চাকরিতে ঢুকি, চেইন স্টোরের আইটি এক্সপার্ট হিসেবে। দুই বছর পর আমি চলে যাই। অন্য কোম্পানি ডেভেলপার খুঁজছে। আমি সেখানে গেলাম। ২০০৩ সালে নতুন চাকরি। শপিং ডটকম। এখনো এখানে আছি। পরে কোম্পানির আইটি হেড হয়ে গেলাম।’ 

আলফা নেট
নিজের আলফা নেট সম্পর্কে সুফিয়ান বলেন, ‘আউটসোর্সিং নিয়ে কাজ শুরু করি একসময়। এটা আসলে করা যায় না। দুনিয়ার এক জায়গা থেকে কাজ নিয়ে আরেক দিক থেকে করিয়ে তা সরবরাহ করা খুব কঠিন। আমাদের দেশে ওয়ার্ক ইথিকসটা ভালো নয়। যদি আপনি ঘাড়ের ওপর বসে না থাকেন, তাহলে কাজ করবে না। এটা একটা লোকের দোষ নয়, এটা কালচারাল প্রবলেম। বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে দেখবেন, কাজের লোকই সব করে। এমনকি মশারি টাঙানো ও এক গ্লাস পানি নিয়ে আসা পর্যন্ত। এভাবে আপনি বড় হলে হঠাৎ করে আপনি কর্মঠ মানুষ হবেন না। সবকিছুর ট্রেনিং লাগে। আমরা ছোটবেলাতেই পঙ্গু হয়ে যাই। বিদেশে ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকে জোর করে কাজ করতে দেয়। বিদেশ থেকে অফিস ম্যানেজ করা প্র্যাকটিক্যালি অসম্ভব।’
আলফা নেটের ভবিষ্যৎ
সুফিয়ান নিজের কাজ নিয়ে বলেন, ‘আমেরিকায় আমাদের বড় কিছু প্রজেক্ট আছে। এর মাধ্যমে দেশে ডাটা এন্ট্রিসহ বিভিন্ন পদে কর্মসংস্থান বাড়াব। এখন ২০ জনের মতো কাজ করছেন। শিগগিরই ৫০ জনের ওপরে এই সংখ্যা যাবে।’

বাংলাদেশ সম্পর্কে সুফিয়ান বলেন, ‘ডিজিটালি সবকিছু উন্নত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে আমাদের তেমন একটা অগ্রগতি নেই। এ জন্য মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইট দরকার, যাতে সব হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, হোটেল, ঐতিহাসিক স্থাপনা, চেইন শপ, ব্যাংকের ঠিকানা যেন সহজেই পাওয়া যায়। এ ধরনের ওয়েবসাইট চালু করব। এই ওয়েবসাইট আপনার আশপাশের ব্যাংক এবং এটিএম বুথ, মসজিদ খুঁজে কোনটা কত দূরে আছে দেখিয়ে দেবে। এ ছাড়া কোন ব্যাংকের কত শাখা, প্রতিটি শহরের কোথায় আছে তা জানতে পারবেন। এর সঙ্গে hotel.info.bd, hospital.info.bd, school.info.bd, college.info.bd, ngo.info.bd, insurance.info.bd, masjid.info.bd,tourist.info.bd, job.info.bd, freelance.info.bd ইত্যাদি ওয়েবসাইটের কাজ চলছে।’