গিজার কেনার সময় যে বিষয়গুলো দেখে নেওয়া উচিত
শীতের মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই যে বিপত্তির অনুষঙ্গ আসে তা হলো ঠান্ডা পানিতে গোসলের অস্বস্তি। প্রাথমিক পর্যায়ে অস্বস্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমেই তা ধাবিত হয় সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন ধরনের ঠান্ডাজনিত অসুস্থতার দিকে। এই স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে অনায়াসেই মুক্তি পাওয়ার একটি কার্যকর উপায় হলো গিজার ব্যবহার করা। ইতোমধ্যে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা যন্ত্রটি শীতকালে প্রতিদিনের স্নানকে আরামদায়ক এবং স্বাস্থ্যকর করে তোলে। চলুন,বর্তমান বাজারে চলমান কয়েকটি গিজারের দাম ও ফিচারের পাশাপাশি জেনে নিই- এই গৃহস্থালি যন্ত্রটি কেনার ক্ষেত্রে কোনো বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
গিজার কেনার সময় যে বিষয়গুলো দেখে নেওয়া উচিত
ধারণ ক্ষমতা
পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে একটি গিজারের উপযুক্ত ধারণ ক্ষমতা ভিন্ন হয়ে থাকে। ছোট পরিবারের জন্য সাধারণত ৬ থেকে ১৫ লিটার ইউনিট-ই যথেষ্ট,অপরদিকে বড় পরিবারগুলো জন্য দরকার হয় ২৫ থেকে ৫০ লিটার। ধারণ ক্ষমতা কি রকম হবে তার সঙ্গে সারা মাসে বিদ্যুৎ শক্তির খরচও সম্পৃক্ত। ছোট গিজারগুলো কম শক্তি ব্যবহার করে চাহিদা মেটাতে পারে, অন্যদিকে বড় আকারের গিজারগুলোর জন্য মাসে বিদ্যুৎ বিল অতিরিক্ত বেড়ে যায়।
গিজারের ধরন
গিজার প্রধানত দুই ধরনের হয়- ইন্স্ট্যান্ট এবং স্টোরেজ। ইন্স্ট্যান্ট মডেলগুলো চাহিদা অনুযায়ী পানি গরম করে, স্থাপনে কম জায়গা নেয়, এবং বিদ্যুৎ শক্তি সঞ্চয় করে। এগুলো মূলত রান্নাঘর বা ছোট বাথরুমের মতো সংকীর্ণ রুমগুলোতে স্থাপনের জন্য উপযুক্ত। আর স্টোরেজ গিজারে থাকে উত্তাপযুক্ত ট্যাংক,যেখানে পরবর্তীতেও ব্যবহারের জন্য গরম পানি সংরক্ষণ করা থাকে। ফলে দিনে দুইয়ের অধিকবার গোসল করা যায়। পাশাপাশি অতিরিক্ত লোড নিতে পারে বিধায় স্টোরেজের মডেলগুলোতে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়।
কর্মদক্ষতা
পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ের জন্য উচ্চ কর্মদক্ষতা সম্পন্ন গিজারের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এর জন্য উচ্চ শক্তির স্টার রেটিং বা উচ্চ-ঘনত্ব পিইউএফ (পলিউরেথেন ফোম) নিরোধকের মতো উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কিনা তা দেখা উচিত। এই ধরনের নিরোধক তাপের অপচয় রোধ করে পানির তাপমাত্রা বেশিক্ষণ ধরে রাখে এবং কম বিদ্যুৎ খরচ করে। এর সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় শাটঅফের ফিচারটি থাকলে সর্বোত্তম কর্মক্ষমতা নিশ্চিতের জন্য অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের দরকার হয় না।
পানির ট্যাংকের গাঠনিক উপাদান
পানি সংরক্ষণের ট্যাংকটি কি ধরনের উপাদান দিয়ে বানানো হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে গিজারের স্থায়িত্ব এবং কার্যক্ষমতা। স্টেইনলেস স্টিলের ট্যাংকে প্রায়শই কাচ বা এনামেলের প্রলেপ থাকে। এতে করে পুরো গঠনটি ক্ষয় প্রতিরোধী হয় এবং উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। একইভাবে,এবিএস প্লাস্টিকের ট্যাংকগুলো ওজনে হালকা,মরিচারোধী এবং সহজে রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য হয়। এভাবে যন্ত্রটি টেকসই হওয়ার মাধ্যমে এতে কোনো রকম ফাটল বা চিড় ধরার আশঙ্কা লোপ পায়।
গরম করার উপকরণ
পানি কতটা দ্রুত গরম হচ্ছে এবং উষ্ণতার মাত্রা কতটুকু এগুলোর জন্য কিছু উপকরণের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। এক্ষেত্রে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য উপাদান হচ্ছে কপার, কেননা এর আছে উচ্চতর তাপ পরিবাহিতা এবং স্থায়িত্ব। এর বিকল্প হিসেবে গ্লাসের প্রলেপ থাকা উপাদানগুলোর যান্ত্রিক ক্ষয় প্রতিরোধ এবং আয়রনযুক্ত পানি প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা রয়েছে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে রক্ষণাবেক্ষণের খরচও যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে আনে।
নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য
অধিকাংশ গিজারের একটি সাধারণ যন্ত্রাংশ হলো থার্মোস্ট্যাট। যখন যন্ত্রের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয় তখন এর চাপ রিলিজ ভাল্বগুলো খুলে যায়। এভাবে গিজার অতিরিক্ত গরম হওয়া থেকে মুক্তি পায়। এর সঙ্গে আরও যুক্ত করা যায় শকপ্রুফ এক্সট্যারিয়র এবং ড্রাই হিটিং সুরক্ষা,যেগুলো নানা ধরনের বৈদ্যুতিক বিপদের আশঙ্কা দূর করে। এই অন্তর্ভুক্তিগুলোতে অতিরিক্ত খরচের ধাক্কা থাকলেও বাসা-বাড়িতে নিরাপদে থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করে।
স্থাপনের জায়গা
বাথরুম বা রান্নাঘরে যে স্থানেই বসানো হোক না কেন,সেই জায়গাটির প্রশস্ততা এবং উচ্চতা কতটুকু তা আগে থেকেই দেখে নিতে হবে। উল্লম্ব গিজারগুলো সীমিত প্রস্থের লম্বা বাথরুমের জন্য প্রযোজ্য,অপরদিকে অনুভূমিকগুলো উচ্চতায় কম অথচ প্রশস্ত সিলিং স্পেসগুলোতে ভালো ফিট করে। এই জায়গা নির্ধারণটি গিজারের সুষ্ঠভাবে কাজ করার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয়।অপর্যাপ্ত জায়গায় যন্ত্রের সামগ্রিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে।
ওয়ারেন্টি এবং বিক্রয় পরবর্তী সেবা
যেকোনো ইলেক্ট্রিক যন্ত্রপাতির গুণমানের নিশ্চয়তা বিচারের একটি বড় নির্ধারক হলো ওয়ারেন্টি। সার্ভিস ও পার্টস দুটোতেই ওয়ারেন্টি থাকলে সেই যন্ত্রের কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের প্রতি নির্ভরতা বাড়ে। বিষয়টি গিজারের জন্যও প্রযোজ্য। স্ট্যান্ডার্ড কভারেজ ট্যাংকের জন্য ৩ থেকে ৫ বছর এবং গরম করার সামগ্রীগুলোর জন্য ১ থেকে ২ বছর ওয়ারেন্টি থাকা উচিত। সেই সঙ্গে ডিস্কেল করা এবং নিরাপত্তা ভাল্ব চেক করার মতো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণগুলো করা হলে তা যন্ত্রের আয়ু বাড়ানো ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গিজারে যুক্ত হচ্ছে নতুন প্রযুক্তি। তেমনি একটি প্রযুক্তি হচ্ছে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী সেটিংস,যেখানে পছন্দ অনুযায়ী যন্ত্রের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সেট করা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো গিজারে সামঞ্জস্যযোগ্য নব থাকে;একদম সাম্প্রতিকগুলোতে থাকে ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এই ফিচারের মূল উদ্দেশ্য হলো যন্ত্রের কার্যক্ষমতার সঙ্গে আরামদায়ক উষ্ণ গোসলের সমন্বয় করা। এতে করে যন্ত্র সর্বোচ্চ পাওয়ারে পরিচালিত হয় না বিধায় তাপশক্তি অপচয় কমে এবং সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ শক্তিও তুলনামূলকভাবে কম খরচ হয়।
সবশেষ, উপরোক্ত গরম পানির গিজারগুলোর মাধ্যমে এক নজরে চলমান শীতের বাজারের ধারণা লাভ করা যায়। মূলত পরিবারের সুনির্দিষ্ট চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গিজারের ধারণক্ষমতা, কর্মদক্ষতা ও ওয়ারেন্টিসহ প্রয়োজনীয় ফিচারগুলো যাচাই করা উচিত। বড় পরিবারের জন্য ওয়াল্টনের ৬৭ লিটারের মডেলটি উৎকৃষ্ট, অন্যদিকে হায়ারের ৩০ লিটারের মডেলটি ভারসাম্যতা দিচ্ছে দক্ষতা এবং স্থায়িত্বে। বাজেট-সচেতন ক্রেতাদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে দেওয়ানকো বা ভিশন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কর্মদক্ষতার বিচারে এগিয়ে থাকবে মিডিয়ার ডি৪০। উপরন্তু, দীর্ঘ মেয়াদে খরচ বাঁচানোর ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ফিচারকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্রয়ের সময় বাজেট বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটু নমনীয় হওয়া উত্তম।