আমঝুপি নীলকুঠি

Looks like you've blocked notifications!
মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি। ছবি : লেখক

আমঝুপি নীলকুঠি; নামের মধ্যেই কেমন যেন একটা আকর্ষণ ছড়িয়ে আছে। তাই বোধ হয় শুধু নাম শুনেই একটা কৌতূহল তৈরি হলো মনে। নীলকুঠি নামের সঙ্গে বেশ আগে থেকেই পরিচিতি ছিল, যে ব্রিটিশ আমলে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক অত্যাচারের নাম নীল, আর সেই অত্যাচারকে বাস্তবায়িত করার জন্য বাংলার নানা প্রান্তরে তৈরি করা হয়েছিল নীলকুঠি। যেখানে বসে আরাম-আয়েশ করে নীলচাষিদের নানা রকম অত্যাচারের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হতো। কিন্তু আমঝুপি নামটা একদমই নতুন আর সেইসঙ্গে বেশ কৌতূহল-জাগানিয়া। তাই তো সহকর্মী যখন একই সঙ্গে আমঝুপি নীলকুঠি যাওয়ার পরামর্শ দিল, তখন থেকে বেশ রোমাঞ্চিত আমি।

পরদিন সকালে মেহেরপুরে আমাদের প্রথম গন্তব্য আমঝুপি নীলকুঠি ভ্রমণ। সকালে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মেহেরপুর শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে আমঝুপি নীলকুঠির অবস্থান। বেশ সকাল বলে হাইওয়ে একদম ফাঁকা ছিল। তাই ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যের কাছাকাছি প্রধান সড়কের সঙ্গে নামফলক দেওয়া সংযোগ সড়কের কাছে। এক-দেড় মিনিট গেলেই আমঝুপি নীলকুঠির গেট। শুরুতে গেট দেখে তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু একটু ভেতরে গিয়ে নীরব, নির্জন, সবুজের ছড়াছড়ি; প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ আর বিশাল একটা আমের বাগান দেখে ভালো লাগাটা শুরু হলো। সামনে এগোতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে ভালো লাগাটা, একসময় মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে দিতে, একসময় আমার প্রিয় তালিকায় নিজের জায়গা করে নিল।

আসলেই তাই, শুরুতে তেমন কিছু মনে না হওয়াটা, ঢুকে অল্প অল্প ভালো লাগতে শুরু করাটা পুরো আমঝুপির চারপাশ দেখার পর একটা ভালো লাগায় ঘিরে ধরেছিল। যে কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জায়গাটা আমার প্রিয় তালিকায় করে নিতে পেরেছে। কারণ, ভালো লাগা, মুগ্ধ হওয়া আর সময় কাটানোর দারুণ-মনোরম একটা জায়গা এই আমঝুপি নীলকুঠি। ছোট কিন্তু গোছানো আর পরিচ্ছন্ন সবুজের মাঝে প্রাচীন স্থাপনা, ইতিহাস আর সেকালের ঐতিহ্য উপস্থাপন করলেও সেই তিক্ত ইতিহাসকে ছাপিয়ে আমঝুপির প্রকৃতি, পরিবেশ আর চারপাশের সৌন্দর্য আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের আর আকর্ষণীয় লেগেছে।

এই ঐতিহাসিক আঙিনায় পা রাখতেই হাতের বাঁয়ে এক বিশাল আমবাগান, একই আকারের সব আমগাছ, তার বিশাল বাগানকে একটা ঝুপড়ির আকার করে রেখেছে প্রাকৃতিকভাবেই। যেটা প্রথম দর্শনেই চোখে পড়ে। আর একঝলক দেখেই উপলব্ধি করা যায় আমঝুপি নামের সার্থকতা। যেটা বেশ দুর্লভ একটা ব্যাপার, যে জায়গার পরিবেশ তার নামকরণের সার্থকতা বহন করতে পারে, তার নামকরণের ইতিহাস না জেনেই। ডানে বিস্তৃত সবুজ মাঠ, যা একসময় হয়তো এই নীলকুঠির প্রাচীন স্থাপনাগুলোর আঙিনা বা উঠান ছিল বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। সবুজ মাঠের মাঝে দু-একটি গাছ, পাকা বেড়ি দিয়ে তাকে আগলে রাখার চেষ্টার পাশাপাশি আগত দর্শনার্থীকে সাময়িক বিশ্রামের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আমরা ঠিক সেই গাছের নিচে, পাকা বেদির পাশেই নিজেদের প্রাথমিক অবস্থান নিয়ে বাইক আর ব্যাগপত্র রাখলাম। পাকা বেদিতে একটু বসে চারদিকে তাকালাম।

বেশ স্নিগ্ধ, মন ভালো করে দেওয়া শান্ত প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা চারপাশ। বিস্তৃত সবুজ মাঠ, ক্ষয়ে ক্ষয়েও নিজেকে টিকিয়ে রাখা ব্রিটিশ স্থাপনা, নীলকুঠির দুটো ইটের ভবন। সামনে খোলা বারান্দা আর তার সঙ্গে প্রায় একই রকম বেশ কয়েকটা রুম। দেখে মনে হলো, সেই সময়ের নীলকর আদায়ের অফিসরুম হবে হয়তো। ইতিহাস খুঁজে দেখিনি, তবে আপাত দেখায় তেমনি মনে হলো। একতলা দুই ভবনের সামনে একটা জলের আয়োজন পরিত্যক্ত কল। পরিত্যক্ত ভবনের পেছন দিক দিয়ে বয়ে গেছে স্থানীয় কাজলা নদী। শ্রাবণে তার ভরা যৌবন, রং, রূপ, রস আর গন্ধে টইটম্বুর। যে কাউকে বেঁধে ফেলতে পারে গড়ন, গঠন আর তার টলটলে রূপের প্রবাহ দিয়ে। আর চারপাশে তো আছেই খুচরো রূপের কত চাহনি। যে রূপের মায়ায় বাঁধা পড়ে গিয়ে প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ। যেমন আমি পড়েছি। আর তার নাম বদলে দিয়ে কাজলী করে নিয়েছি নিজের মতো করে।

এই নদীর তীরেই নীলকুঠির মূল ভবন। পরিত্যক্ত দুই ভবন থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মাঠ আর ইটের পথ। তবে নদীর তীরঘেঁষেও চলে যাওয়া যায় সেই হলদে ভবনের আঙিনায়। নদীর পাশে নীলকুঠির মূল ভবন ও বাগানের সবটুকু। এখন যা ঐতিহাসিক নিদর্শন আর পার্ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অবশ্যই কিছু অর্থের বিনিময়ে মূল ভবন আর সবুজে ছাওয়া নদীর তীরঘেঁষে সবুজ সেই পার্কে প্রবেশ করে উপভোগ করতে হয়। সেটা বন্ধ ছিল আর আমাদেরও পয়সা খরচ করে পার্ক দেখার খায়েশ নেই বলে সেদিকে এগোইনি। গেটের বাইরে থেকে, নদীর তীরঘেঁষে, গাছের ছায়ায় বসে, আমঝুপির মাঝে হেঁটে দেখছিলাম চারদিকটা, আর ভাবছিলাম ইংরেজরা শত শত বছর আগে থেকেই, দূরে, নির্জনতায়, সবুজের মাঝে, নদীর তীরে, একদম প্রকৃতির সবটুকু সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা কোনো না কোনো জায়গায় তাদের অবসরের আবাস গড়ত, খুঁজে নিত আর সেখানে অপূর্ব একটা অবসর কাটানোর সব আয়োজন করে নিত।

এই আমঝুপি নীলকুঠি তার প্রমাণ। কী অপরূপ, প্রকৃতির মাঝে, সবুজে ঘেরা, নদীর তীরঘেঁষে তৈরি করা সেই সময়ের আবাস, অফিস আর অবসরের নির্জনতা, নীরবতা, একান্ত সময় কাটানোর অবাক আয়োজন।

আমঝুপি নীলকুঠি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আর মনে মনে কল্পনা করতে বাধ্য করেছে, আমার যদি থাকত এমন একটা আমঝুপি নীলকুঠি!