গারো পাহাড়ের সীমান্ত ধরে

Looks like you've blocked notifications!

ঘরবন্দি থেকে  হাঁপিয়ে উঠে এক উইকেন্ডে হুটহাট সিদ্ধান্তেই বেরিয়ে পড়লাম। মহাখালী বাস স্টেশনে সফরসঙ্গী হিসেবে যোগ দিল নিয়মিত পার্টনার সুজন ভাই। অনেকটা লটারির মতো ব্যাপার। দশ থেকে বিশজন গুণে গন্তব্য ঠিক করে লেঙ্গুড়ার বাসের টিকেট কাটলাম। উদ্দেশ্য কলমাকান্দার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা এবং মেঘালয় সীমান্ত ধরে যত দূর সম্ভব ঘুরে দেখা।

নেত্রকোনা সদর পেরিয়ে রাস্তা ধরে সাতসকালে গিয়ে পৌঁছালাম লেঙ্গুড়া। রাস্তার অবস্থা দেখেই বোঝা যায় পর্যটন শিল্পের বিকাশে কতটা অনুকূল এই এলাকা। তবু পাহাড়, টিলা, নদী আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এই এলাকা হতে পারে পর্যটকদের আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

বাস থেকে নেমে ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। আমাদের নির্দিষ্ট কোনো ভ্রমণ পরিকল্পনা না থাকলেও মেঘালয়ের পাহাড় বেয়ে নেমে আসা গণেশ্বরী নদী। যেটা ছিল আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য। স্থানীয় কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করে হাঁটা শুরু করলাম। নদীর খোঁজে কিছু দূর এগোতেই আকাশ ভেঙে যেন ঝুম বৃষ্টি নামল। রাস্তার পাশে এক টিনের চালের ফাঁকা মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। এর মধ্যেই বৃষ্টি আরও প্রবল হলে গা এলিয়ে তা উপভোগ করছিলাম। ঘণ্টাখানেক পর আকাশ শান্ত হলে হাঁটা শুরু করলাম আবার। মাঝে বাজারের এক চায়ের দোকানে বসে চা পান করলাম। নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে যুবকের অত্যধিক আগ্রহেই সীমান্তের কাছাকাছি সাত শহীদের মাজারে গেলাম। ঘন গাছগাছালির ফাঁকে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাতজন মুক্তিযোদ্ধার কবর এখানে। এই মাজারের পর থেকেই মূলত ভারতের সীমান্ত এবং যেখান থেকে পাহাড়ি এলাকার শুরু।

শহীদ স্মৃতিসৌধ ঘুরে ফিরতি পথে আসলাম মোমিনের টিলার খোঁজে। এখানকার বড় বড় পাহাড়গুলো ভারতের সীমানার ভেতরে থাকলেও বাংলাদেশ সীমান্তে বেশ কিছু টিলা আছে যেখান থেকে পুরো এলাকার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। তেমনি এক টিলা মোমিনের টিলা। চমৎকার এক ক্যাম্পিং সাইট হতে পারে এই টিলা। টিলা এলাকায় ছাতা, বেঞ্চসহ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও অবহেলায় এখন তা অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এখান থেকে গণেশ্বরী নদীর পুরো ভিউ পাওয়া যায়।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেংমাং নামক গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক অদ্ভুত সুন্দর নদী গণেশ্বরী। নদীর শেষ প্রান্তে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে ছেয়ে আছে ঘন কালো মেঘে। আর অপর পার্শ্বে ছোট ছোট টিলা। টিলার পাশ ঘেঁষে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জনবসতি। গণেশ্বরীর উৎপত্তিস্থল থেকে বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে নেত্রকোনা শহরের পূর্বধলার কাছাকাছি জাঞ্জাইলে কংস নদীতে গিয়ে মিশেছে। শীতের সময় স্বচ্ছ পানিতে নিচের চিকচিকে বালি দেখা গেলেও বর্ষা হওয়াতে পানি বেশ ঘোলাটে।

ঘুরে ফিরে দেখা শেষ হলে নেমে এলাম টিলার অপর পাশ ধরে। রাস্তায় নেমে কিছু সময় অপেক্ষা করতেই মোটরসাইকেল পেলাম। এই অঞ্চলের সুবিধা হচ্ছে সর্বত্র ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল পাওয়া যায় চলাচলের জন্য। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় মোটরসাইকেলে সোজা চলে এলাম দুর্গাপুর। দুর্গাপুর বাজার থেকেই খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম একবারে। বিরিশিরির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি হয়ে সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে এসে পৌঁছালাম। ঘাটের পাশেই সারি বেঁধে চলছে বালু উত্তোলন। সোমেশ্বরীকে বলা যায় বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর নদীগুলোর একটি। সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদীর মতোই নীল পানি দেখা যায় শুকনো মৌসুমে এলে। বর্ষাকাল হওয়াতে এখন নদীতে পানির বেশ স্রোত।

ঘাট থেকে নৌকায় নদী পার হয়ে দাঁড়াতেই মোটরসাইকেল আর অটোচালকেরা ঘিরে ধরল। এই এলাকা ঘুরতে এলে সাধারণত সবাই অটো রিজার্ভ করে।

এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে আমরা সীমান্তবর্তী রাস্তা ধরে চলে যাব ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পর্যন্ত। সেভাবেই বাইকচালকের সাথে দরদাম করে ৭০০ টাকায় ঠিক করলাম।

প্রথমেই এসে পৌঁছালাম দুর্গাপুরের বিখ্যাত চীনামাটি পাহাড় এলাকায়। চিনামাটির পাহাড় থেকেই পাশের নীলপানি জলাশয় দেখা যায়। বর্ষাকাল হওয়াতে পানি নীল না হয়ে বরং কর্দমাক্ত হয়ে আছে। তবু জনশূন্য হওয়াতে বেশ উপভোগ্যই ছিলো ঘুরে বেড়ানো। সেখান থেকে বিজয়পুর সীমান্ত এবং চার্চ এলাকা ঘুরে চলে এলাম সোমেশ্বরীর পাশে এক চায়ের দোকানে। বাইকচালকের বিশেষ আগ্রহে চা খাওয়া হলো এক দোকানে। পাশেই নদীতে দেখলাম অনেকগুলো নৌকা ব্যস্ত মাছ ধরাতে। পরে জানতে পারলাম তারা মূলত মাছ ধরা নয়, নদী থেকে কয়লা তুলতে ব্যস্ত। এই সিজনে পানির স্রোত বেশি থাকাতে ভেসে আসা কয়লা উত্তোলন করে স্থানীয়রা। পরিমাণ ভালো হলে বেশ লাভবানও হওয়া যায়। চায়ের দোকানের পাশেই কয়লার বিশাল স্তূপ। চা-পর্ব সেরে এবার আমাদের ছুটে চলা পর্ব শুরু হলো।

বিজয়পুর থেকে ধোবাউড়া পেরিয়ে কিছু দূর যেতেই সাইনবোর্ডে নাম চোখে পড়ল কলসিন্দুর। নামটা এত পরিচিত যে মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল কলসিন্দুরের বিখ্যাত কিশোরী ফুটবলারদের কথা। মনে পড়বে না-ই বা কেন। অনেকটা রূপকথার মতোই যে তাদের সফলতার গল্প। বাইক চালককে বলতেই নিয়ে গেল কিশোরীদের ফুটবলার হয়ে ওঠার আতুরঘর সেই সরকারি স্কুলের সামনে। কেবল ভাবছিলাম এমন প্রত্যন্ত একটা অঞ্চল থেকে যেভাবে উঠে এলো এমন  ফুটবল দল। বাজারের পাশেই বিশাল সেই স্কুল মাঠ আর পাশেই নতুন তৈরি করা প্রধানমন্ত্রীর উপহার কলেজ ভবন। বাইক চালক জানাল, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলেও এখানে দ্রুতই পৌঁছেছে বিদ্যুতের সুবিধা আর তা কেবলই এই কিশোরীদের আবদার সাপেক্ষে।

মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে ছুটতে লাগল আমাদের বাইক। সারা রাতের ঘুম যেন চেপে বসল। অবশেষে পথে এক বাজারে থেমে চা খেয়ে ঘুম তাড়ানো হলো। সাথে মিষ্টিও খাওয়া হলো। লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে পৌঁছালাম হালুয়াঘাট।

হালুয়াঘাট নেমে যদিও পরিকল্পনা ছিল সীমান্তের রাস্তা ধরেই শেরপুরের পানিহাটা পর্যন্ত যাওয়ার। কিন্তু সময়ের অভাবে সে প্ল্যান বাদ দিতে হলো। এখান থেকেই ঢাকা ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে তার আগে অতি অবশ্যই খুঁজে বের করলাম হালুয়াঘাটের ঐতিহ্যবাহী ছালামের স্পঞ্জ মিষ্টির দোকান। শেষ বিকেলের দিকে এসে বাস স্টেশন পৌঁছালাম। একটি চমৎকার দিনের কিছু অসাধারণ স্মৃতি নিয়ে ফেরার পথে রওনা হলাম।