চলুন যাই মতিরহাট মেঘনাতীরের বেলাভূমিতে
ঢেউ আসে। ঢেউ খেলে। আছড়ে পড়ে। মোহনার পলিমাটি দিয়ে গঠিত এ বেলাভূমির কূল ছুঁয়ে সে দৃশ্য চমকে দেয় ভ্রমণপিপাসুদের চোখ। বেলাভূমির সে পথ ধরে ঢেউয়ের কূল ছোঁয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ভ্রমণপিয়াসীরা হারিয়ে যান অচিনপুরে। মেঘনাতীরের এমন মনভোলানো সৌন্দর্য দেখে কক্সবাজার সৈকত কিংবা কুয়াকাটা সৈকত ভেবে ভুল করে ফেলেন অনেকে। তবে এটি যে এখানকার মানুষের জন্য তেমন কিছুই, তা আবার কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।
মেঘনা নদীর পূর্ব উপকূলে জেগে ওঠা এ সম্ভাবনাময় দর্শনীয় স্থানটির স্থানীয় নাম ‘মতিরহাট মেঘনা বিচ’। এটি লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরের চর কালকিনিতে অবস্থিত। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ভোলা-বরিশালের এ নৌপথের তীরের এ বেলাভূমি প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নদীর বুকে চোখজুড়ানো রঙিন জলরাশি, মুক্ত শীতল বাতাসের উন্মাদনায় মেতে ওঠেন ঘুরতে আসা দর্শনার্থী।
বসন্তের মাতাল হাওয়ায় কেউ কেউ গানের দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। সুর মাখিয়ে গলা ছেড়ে গান গান। হাঁটেন বেলাভূমির বালুময় পথে পথে। মতিরহাট মেঘনা তীর রক্ষা বাঁধ থেকে দক্ষিণে মেঘনার তীরে এক কিলোমিটার পথ এমন বেলাভূমি। বিশাল প্রশস্ত এ তীরে কেউ কেউ ফুটবল, ক্রিকেট উন্মাদনায় মেতে ওঠেন।
যা দেখতে পাবেন
নদীর বিশাল মোহনায় চোখ রাখলে দেখা বৈচিত্র্যময় নানা দৃশ্যপট। চোখে পড়বে ছোট-বড় নৌকা। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকাগুলো নাচ করে। জেলেরা সে নৌকা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মোহনায় জাল ফেলছেন, ইলিশ ধরছেন। সেসব আবার মাছঘাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। ইলিশ শিকারের জন্য জেলেরা আগে থেকেই পরিকল্পনা করেন। প্রতিদিন জোয়ারের দুই সময়ে জেলেরা ইলিশ শিকারে নদীর বুকে ছোটেন। খুব কাছ থেকে নৌকার কলকল ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাবে জেলেদের ইলিশ শিকারের সেই চিরচেনা দৃশ্য।
মেঘনা ‘সৈকতে’ আরেক আকর্ষণ দুই ধারের সবুজ প্রকৃতি। মেঘনার তীরের সবুজ গাছগাছালির দৃশ্য আর মেঘনার মোহনার নয়নাভিরাম দৃশ্য মিশে যেন একাকার। সকাল, দুপুর কিংবা সন্ধ্যে—সব সময় এমন দৃশ্য উপভোগ করতে ভিড় জমান বিভিন্ন বয়সী মানুষ।
তবে জোয়ারের সময় এ বেলাভূমি দেখা যায় না। আবার নদীতে পানির তীব্রতা কম থাকলে সচরাচর এ দৃশ্যের দেখা মেলে। সকালে নদীতে যখন ভাটা থাকে, তখন সূর্যের বর্ণিল আলো আকাশে মিশে এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করে। আবার সূর্যাস্তও বেশ উপভোগ্য এ ‘সৈকতে’। এখানে সূর্যাস্তের দৃশ্যে যে কেউ হারিয়ে যেতে পারেন কল্পরাজ্যে।
বেলাভূমিতে জোয়ারের দৃশ্যও দারুণ। জোয়ার যখন আসে, ক্রমান্বয়ে পুরো বেলাভূমিতে নিচ থেকে ওপরে পানি ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই বেলাভূমিতে পানি ভরে যাওয়ার দৃশ্য প্রাকৃতিক, যা যে কারো জন্য উপভোগ্য।
প্রাণ খুলে উপভোগ করুন
প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে গড়ে ওঠা এ স্থানটি এরই মধ্যে নজর কেড়েছে কাছের ও দূরের দর্শনার্থীদের। ভ্রমণপিপাসু বহু দর্শনার্থী ও ভ্রমণপিপাসু অনেক সংগঠনের পা পড়েছে মতিরহাটের এ মেঘনা ‘সৈকতে’। এখানকার সুন্দর বেলাভূমি যে কারো মনের গভীরে নাড়া দেবে। যে কেউ চাইলে বেলাভূমির পথ ধরে হাঁটতে পারবেন বহু দূর। ইচ্ছে করলে নদীতে গোসল করতেও কারো জন্য মানা নেই। এখানে ‘সৈকত’ ও বেড়িবাঁধ দুটোই রয়েছে। আর নদীর পাড়ে নারকেল-সুপারির বিশাল বাগান তো আছেই, যেখানে বেলা কাটানো কোনো ব্যাপারই না।
কোথায় থাকবেন?
মতিরহাটে এখনো থাকার মতো কোনো আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেনি। রাত্রিযাপনের জন্য অবশ্যই জেলা শহরকে বেছে নিতে হবে। জেলা শহরে উন্নত মানের বেশ কিছু গেস্টহাউস গড়ে উঠেছে। উন্নত মানের দুটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। বাগবাড়ির ঐতিহ্য কনভেশন ও স্টার গেস্টহাউস এবং চক বাজারের সোনার বাংলা আবাসিক রেস্টুরেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধা হাউস অন্যতম। সে ক্ষেত্রে আপনার খরচ পড়বে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
কোথায় খাবেন?
সকাল বা রাতের খাবারটা গেস্টহাউসেই সেরে নিতে পারবেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দিনের বেলায় যেহেতু ভ্রমণে আসবেন, যেহেতু মতিরহাটের মেঘনাতীরে তাজা ইলিশ ভোজনে দুপুরের খাবারও খেয়ে নিতে পারবেন। আর মহিষের খাঁটি দধির স্বাদটাও নিতে ভুলবেন না। চাইলে নদীতীরের ঘাট থেকে ইলিশ আর হোটেল বা দধির দোকান থেকে দধি নিয়ে আসতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন, ইলিশ যেমন তাজা, দধিও তেমন খাঁটি।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সতর্কতা
সাধারণত নদীতে ভাটা থাকলে বিশাল তীর দেখতে পাবেন। কিন্তু জোয়ারের সময় তীর একেবারেই ডুবে থাকবে। আপনি যদিও ভাটার সময় পা রাখলে, তবে আপনাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে নদীর পানি বাড়ে কি না। যদি পানি বেড়ে যায়, তাহলে পানির ডোবার আশঙ্কাও থাকছে। নদীতীর দিয়ে চলার সময় পা যেন পিছলে না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। মেঘনাতীর কোনো অবস্থাতেই যেন আপনার দ্বারা অপরিষ্কার না হয়, যেমন—চিপস, চানাচুরের প্যাকেট মেঘনাতীরে ফেলে আসা যাবে না। এতে নদী ও মেঘনাতীরের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যেভাবে যাবেন মতিরহাট মেঘনাতীর
রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সড়কপথে বাসে করে কিংবা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চে করে চাঁদপুর হয়ে জেলার শহরের ঝুমুর স্টেশন, তারপর লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের যেকোনো গাড়িতে তোরাবগঞ্জ নেমে সেখান থেকে মতিরহাট সড়ক দিয়ে মেঘনাপাড়ে পৌঁছান। লঞ্চে গেলে খরচ পড়বে আসা-যাওয়া মোট ৮৯০ টাকা আর সড়কপথে বাসে করে গেলে মোট আসা-যাওয়ার খরচ পড়বে ৯৭০ টাকা।