চলুন যাই মনোমুগ্ধকর চর বিজয়ে
চারদিকে ঢেউভাঙা শব্দ। পায়ের নিচের বালুকাবেলায় সবুজ ঘাসের নৃত্য। বাতাসের ট্রেনে চড়ে হাজির হয় সো-সো ছন্দ। এ যেন প্রকৃতির ভাষায় এক গানের আসর। এমন পরিবেশনার ভাষাকে গান না বলে বাতাসের কবিতা বললেও ভুল হবে না। কারণ, ‘সমুদ্র’ নিজ ভাষায় সব আয়োজন একমঞ্চে একসঙ্গেই উপস্থাপন করে। সমুদ্রের এই সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে চাইলে যেতে হবে ‘চর বিজয়’।
কোথায় চর বিজয় ?
পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতী থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের একটি দ্বীপের নাম চর বিজয় (Chor Bijoy)। গভীর সমুদ্রে জেগে থাকা মনোমুগ্ধকর সেই দ্বীপটি। আনুমানিক পাঁচ হাজার একর আয়তনের দ্বীপটি বর্তমানে দেশের একটি নতুন পর্যটন সম্ভাবনার কেন্দ্র।
চর বিজয়ের নামকরণ
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে একদল ভ্রমণ পিপাসু এই দ্বীপের সন্ধান পায়। বিজয়ের মাসে আবিষ্কারের কারণে দ্বীপটিকে চর বিজয় বা The Victory Island নামে নাম দেন তাঁরা। তবে স্থানীয় জেলেদের কাছে এটি হাইরের চর (মাছ ধরার সীমানা) নামেই পরিচিত।
যা আছে চর বিজয়ে
হাজারো অতিথি পাখির বিচরণে একাকার হয় চর বিজয়। দেখলে মনে হবে, আকাশ আর জলের যৌথ মিলনে এখানে সৃষ্টি হয়েছে এক পাখির পৃথিবী। সমুদ্র বা মাছের ট্রলার থেকে ছো মেরে আনা মাছটিকে নিয়ে এখানে পাখা থামে গাঙ পায়রাদের। আছে বক, শঙ্খচিল, মাছরাঙা, কোকিল, ঘুঘু, চ্যাগা, গাঙচিল, ঈগল, শকুন, পানকৌড়ি, শামুকখোলা ইত্যাদি নানান প্রজাতির পাখি। বালুর চরে সুরঙ্গ করে এখানে ঘর বেধেছে নানা প্রজাতির সরীসৃপ। এখানে বালির গর্তে ডিম পাড়তে আসে সমুদ্র কাছিমেরা। আরো হরেক প্রাণীর বসতি আছে এখানে। আছে লাল কাঁকড়া আর গুইসাপসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির প্রাণী।
সাগরলতার রঙিন ফুলেরা বাতাসের আদর গায়ে মেখে বেড়ে ওঠে আপন ছন্দে। দ্বীপের চারদিকে গোলপাতা, ছইলা, কেওড়া ও সুন্দরী গাছসহ প্রায় দুই হাজার ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ মাত্র জেগে উঠছে।
যারা খুব সহজে ক্লান্ত হওয়ার নন, তাঁরা হেঁটে হেঁটে চর দেখেন। এমন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকরাই এখানে আসেন, যারা শুরু থেকে হেঁটে চলেন শেষ সীমানা অবধি। অবশ্য সমুদ্রের যে গর্জন শোনা যায়, সেই সমুদ্রকে নিজ চোখে পুরোটা দেখতে চাইলে একটু হেটেই পৌঁছাতে হবে শেষ প্রান্ত অবধি। চরের শেষ সীমানায় দাঁড়ালেই কেবল দেখা যাবে দেশের শেষ তটরেখায় ঢেউ খেলে যাওয়া সমুদ্রের শোভা।
এখন অবধি এখানে মানুষের বসবাস নেই। সমুদ্রের জেলে আর দিনান্তে কিছু পর্যটক ছাড়া আর কোনো মানুষের আনাগোনা নেই তেমন। এখানকার দৃশ্যগুলো যেন একটু বেশিই সুন্দর। এ যেন আর্টপেপারে নরম তুলিতে আঁকা কোনো দক্ষ শিল্পীর ছবি। দ্বীপে পা রাখলে মনে হবে, এ যেন নির্জন সৈকতের এক নিঃসঙ্গ ভূখণ্ড। এ যেন অথৈ জলরাশিতে ঘেরা একটি সবুজ স্বর্গ।
যাতায়াত ও ভাড়া
ঢাকার সায়দাবাদ ও গাবতলী থেকে কুয়াকাটা রুটের একাধিক বাস চলে। সেসব বাসে সরাসরি কুয়াকাটাতে পৌঁছানো যাবে। যাতায়াত ভাড়া ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া লঞ্চে করে আসা যাবে কুয়াকাটার পথে। সেক্ষেত্রে নামতে হবে বরগুনা জেলাধীন আমতলী লঞ্চঘাটে। লঞ্চে সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১৪০০, ডাবল কেবিন ২২০০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ভাড়া ৩০০ টাকা। লঞ্চ থেকে নেমে লোকাল ট্রান্সপোর্টে কুয়াকাটা অবধি আসতে হবে। এতে খরচ পড়বে আরো ১৫০ টাকা। কুয়াকাটা থেকে স্থানীয় বোটে যেতে হবে চর বিজয়ে। কুয়াকাটা সৈকতেই আছে চর বিজয় ঘুরিয়ে-দেখিয়ে আনার একাধিক ট্রাভেল সার্ভিস। ধরে নিন- তাতে আপনার আরো খরচ হবে কমবেশি ৫০০ টাকা।
থাকা-খাওয়া
চর বিজয়ে থাকা খাওয়ার কোনো জায়গা নেই, আপনাকে থাকতে হবে কুয়াকাটায়। কুয়াকাটায় আগতদের আবাসিক সেবা দিতে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। মাত্র ৫০০ থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা অবধি আরামদায়ক কামরা প্রস্তুত রয়েছে পর্যটকদের সেবায়। আর খাবারের চাহিদা পূরণ করতে এখানে রয়েছে একাধিক রেস্তোরাঁ। এসব রেস্তোরাঁয় মিলবে একাধিক সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি মাছের ভর্তা।
পরামর্শ
১ চর বিজয়ে কোনো দোকান নেই। তাই কুয়াকাটা থেকেই প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার ও পানি সঙ্গে নিন।
২ সকালে চর বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে বিকেলের মধ্যে কুয়াকাটায় ফিরে আসুন।