চলুন যাই রবীন্দ্রনাথের কাছারি বাড়ি
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সবুজ সমারোহে ছেয়ে থাকা এক ছোট্ট গ্রামের নাম পতিসর। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠ, তালগাছের সারি, বটের ছায়া, নদীর হাঁটুজলে কিশোরের দুরন্তপনার পটচিত্র পেরোলেই চোখে পড়বে একতলা শ্বেতশুভ্র কাছারি বাড়ি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটি উচ্চারিত হলেই শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসর—এই তিন এলাকার নাম চলে আসে। কিন্তু পূর্বোক্ত প্রথম নাম দুটি সবার মুখে মুখে ফিরলেও অজ্ঞাতে থেকে যায় পতিসর। অথচ বিশ্ববরেণ্য এই মানুষটি একসময় তাঁর পদস্পর্শে ধন্য করেছিলেন পতিসরের ভূমি, বর্তমানে যা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।
ইতিহাসসূত্রে জানা যায়, ১৮৩০ সালে বিশ্বকবির পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর এ কালীগ্রাম পরগনা কিনে পারিবারিক জমিদারির অংশে অন্তর্ভুক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে প্রথম পদচারণ করেন ১৮৯১ সালের ১৬ জানুয়ারি। এরপর এটাকে খাজনা আদায় ও জমিদারি দেখাশোনার জন্য ব্যবহার করা হয়।
রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য সাত কক্ষবিশিষ্ট এই বাড়িতে প্রথমেই দৃষ্টি কাড়বে সিংহদুয়ার নামক প্রবেশপথের দিকে, যেখানে বীরবিক্রমে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি সিংহ।
পতিসরের এই কাছারি বাড়ির স্থাপত্যশৈলী শিলাইদহ ও শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ির অনুরূপ। দৃষ্টিনন্দন এই কাছারি বাড়িকে ঘিরে এখানে বেশ কিছু ভবনও রয়েছে, যেগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনো নজর কাড়ে পর্যটকদের। এ ছাড়া আশপাশে অবস্থিত গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাহক মাটির দ্বিতল বাড়িগুলো সৌন্দর্যবর্ধন করে চলেছে দীর্ঘকাল। রয়েছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপদে অবস্থান ও বিশ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতিনীড় নামক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক বিশ্রামাগার, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন ও রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা।
কাছারি বাড়ি-সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্বাংশে নির্মাণ করা হয়েছে দেবেন্দ্র মঞ্চ, কবির স্বপ্নের নাগর নদের ওপর রবীন্দ্র সেতু, পাশে নাগর ঘাট, মণিতলায় তালগাছ ছড়ার সেই তালগাছ স্মৃতিস্মারক এবং দর্শনার্থীদের জন্য পিকনিক স্পট, রন্ধনশালা ও পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা। নির্মাণাধীন রবীন্দ্র স্মৃতি বিনোদন পার্ক। তবে বাড়িটির সম্মুখ পশ্চিমাংশে রবীন্দ্র সরোবর নামক পুকুরটি বর্তমানে মজা-ডোবায় পরিণত হয়েছে।
সামনে বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, পাশ দিয়ে বয়ে চলা নাগর নদ, গ্রাম-বাংলার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের হাতছানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপেক্ষা করতে পারেননি। রচনা করেছেন অনবদ্য ছড়া, কবিতাসহ সমাদৃত সাহিত্যকর্ম।
যা রয়েছে এখানে
প্রায় এক একর জমির ওপর অবস্থিত এই কাছারি বাড়িতে সংরক্ষিত রয়েছে বিশ্বকবির ব্যবহার্য আসবাবপত্র—যার মধ্যে রয়েছে আরামকেদারা, বাথটাব, ফোল্ডিং চেয়ার, কৃষি ব্যাংকে ব্যবহৃত সিন্দুক, কলের লাঙলের ফলা, পদ্মা বোটের নোঙর, বোটের দরজার পাল্লা, ওয়্যারড্রোব, সিন্দুক, ভাতের পাত্র, বোটে ব্যবহৃত গ্লোব, ব্যবহৃত পদ্মা বোটের অনুকৃতি, কবির স্বহস্তে লেখা বহু চিঠিপত্র, দেয়াল আয়না, নাগর বোটে ব্যবহৃত দেয়ালঘড়ি, কেটলি, কাঠের আলমিরা, কাছারি বাড়িতে ব্যবহৃত সেই সময়ের খাট, টেবিল, চেয়ারসহ কবির অসংখ্য ছবি। বাড়িটির প্রাঙ্গণে রয়েছে রবীন্দ্র ভাস্কর্য এবং রবীন্দ্র সরোবরের সম্মুখে তাঁরই আবক্ষমূর্তি।
যাতায়াত ব্যবস্থা
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। তাই ভ্রমণপিপাসুরা নিঃসন্দেহে ট্রেনে আসতে পারেন এখানে। ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন নীলসাগর, লালমনি এক্সপ্রেস অথবা দ্রুতযানে চড়ে প্রথমে আত্রাই আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৩৪০ টাকা। অথবা বাসযোগে নওগাঁ বা নাটোরে এসে সেখান থেকে আত্রাই হয়ে পতিসর। নওগাঁ থেকে পতিসরের দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার। বাসে ভাড়া লাগবে ঢাকা-নাটোর ৩৮০ টাকা এবং ঢাকা-নওগাঁ ৪০০ টাকা। কেউ চাইলে বর্ষা মৌসুমে নাটোর হতে নৌকাযোগেও সরাসরি আসতে পারেন। নওগাঁ থেকে আত্রাই আসার একমাত্র যান হলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ভাড়া পড়বে ৬০ টাকা। চাইলে মিনিবাস রিজার্ভ করেও আসা যাবে। আত্রাই থেকে পতিসরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। আত্রাই থেকে পতিসর আসতে হলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা চার্জার ভ্যানে আসা যাবে। এ ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা করে।
কোথায় থাকবেন
কাছারি বাড়ির দক্ষিণে শানবাঁধানো রবীন্দ্র সরোবরের পশ্চিম পাড়ে রয়েছে দুটো ডাকবাংলো। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এই ডাকবাংলো দুটিতে চারটি করে মোট কক্ষ রয়েছে আটটি। সাধারণ তিনটি কক্ষে জনপ্রতি ভাড়া ১৫০ টাকা এবং দুজন হলে ২০০ টাকা। ভিআইপি পাঁচটি কক্ষের ভাড়া ৮০০ টাকা করে। প্রতিকক্ষে থাকা যাবে দুজন করে। ডাকবাংলো দুটোয় থাকতে হলে জেলা পরিষদের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং খাবারের বিষয়টিও ওখান থেকে নিশ্চিত করে আসতে হবে। এখানকার বিশেষ খাবারের মধ্যে রয়েছে নদী ও বিলের দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ।
প্রয়োজনীয় তথ্য
রবীন্দ্র জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্য দিয়ে টিকেট কাটতে হবে।
১. দেশি পর্যটকদের জন্য ১৫ টাকা
২. মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ টাকা
৩. বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা
৪. সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য ৫০ টাকা
৫. পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য প্রবেশ ফি থাকবে না।
সরকারি ছুটির দিন, রবিবার পূর্ণদিবস, সোমবার অর্ধদিবস (দুপুর দেড়টা হতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা) বন্ধ থাকে। মঙ্গল থেকে শনিবার পর্যন্ত প্রতিদিন খোলা থাকে।
উল্লেখ্য, এই সংরক্ষিত পুরাকীর্তিটিতে কবির জন্মোৎসব (২৫ বৈশাখ) উপলক্ষে সরকারিভাবে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র উৎসব ও তিন দিনব্যাপী (২৫, ২৬ ও ২৭) মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় এখানে ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। এ ছাড়া চাইলে বর্ষাকালে এসে নাগর নদের বুকে নৌকায় কিছুটা সময় প্রফুল্লচিত্তে কাটানো যেতে পারে।
নিষেধাজ্ঞা
কাছারি বাড়িতে সংরক্ষিত কোনো বস্তুর ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ কিংবা সংরক্ষিত বস্তুসমূহ স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। একসঙ্গে ২০ জনের বেশি একই কক্ষে প্রবেশ করা যাবে না। পরিবেশ রক্ষার্থে ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে অশোভন আচরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।