পর্ব-৩

ঝর্ণা দেখতে গিয়ে শামিল হলাম নবান্ন উৎসবে

Looks like you've blocked notifications!
বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়নের অপরূপ সালৌপিপাড়া। ছবি : শাকিল খান

পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সৌন্দর্য। আরও বেশি সৌন্দর্য, পাহাড়ের পেটে ঝরা ঝর্ণায়। যা চোখ ধাঁধানো, মন জুড়ানো। এ পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো পাঁচ দিন। হেঁটেছি বান্দরবানের থানচি থেকে রুমা উপজেলার দুর্গম সব পাহাড়ে। দেখেছি, ছয়টি ঝর্ণার মায়াবী রূপ। পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস করা পাহাড়িদের জীবনাচরণ দেখেছি, শুনেছি তাদের টিকে থাকার গল্প।

তবে পাহাড়ি এ পথ অনেক কঠিন। যদিও তারচেয়ে বেশি নান্দনিক। জীবনের ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর সময়গুলো নিয়ে এ লেখা। আজ থাকছে যার তৃতীয় পর্ব। চলুন, পাহাড় অভিযানের দ্বিতীয় দিন শনিবারের বিকেল থেকে হেঁটে আসি।

আমরা আনন্দিত, রোমাঞ্চিত, পুলকিত। লুং ফির ভা সাইতারের পানি পড়ার শাঁ শাঁ শব্দ হচ্ছে। আমরা ঝর্ণা মাখছি। ঘর্মাক্ত শরীর ভিজিয়ে তৃপ্ত করছি। ছবি তুলছি। ভিডিও করছি। এমন সময়, শাঁ শাঁ শব্দ আরও বেড়ে গেল। কারণ, তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে, ঝর্ণার সৌন্দর্য বেড়ে আরও মায়াবী রূপ নিয়েছে!

মন মাতানো এক দৃশ্য। উপভোগ্য। আমরা লাফালাফি-দাপাদাপি করে চলেছি। জীবনে প্রথম এত দারুণ ঝর্ণা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আমি এত বেশি রোমাঞ্চিত যে, ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, কত নিচ পর্যন্ত ঝর্ণার পানি গড়াচ্ছে। অথচ, স্থানটি ঝুঁকিপূর্ণ।

আমার চালচলন দেখে হঠাৎ এক সহযাত্রী বলে উঠলেন, ‘আর সামনে যাবেন না। নিচে পড়লে একদম মরে যাবেন। চলেন, এখন পাড়ায় যাব। আর দেরি করা যাবে না।’ তখন আমি মূলত মুঠোফোনে ভিডিও করছিলাম।

এবার আমাদের ফেরার পালা। গন্তব্য, সালৌপি পাড়া। এর অবস্থান বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নে।

এদিকে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর ঝর্ণার সংস্পর্শে বেশ ঝরঝরা হয়ে উঠেছে। যে পাহাড় থেকে একটু আগে আমরা লুং ফির ভার নিচে নেমেছি, পাহাড়টি ৯০ ডিগ্রি খাড়া। নামার সময় শুকনা পথ থাকলেও এখন ভেজা। আমরা পাহাড়ে ওঠা শুরু করেছি। ওঠতে ওঠতে মনে হচ্ছে, এ এক ভয়ংকর পথ। সঙ্গে থাকা বাঁশের লাঠির ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কিন্তু, বৃষ্টির পানিতে পিচ্ছিল হওয়া পাহাড়ি পথে লাঠির ভর দিতে কষ্ট হচ্ছে। লাঠি সরে যাচ্ছে। ভয় করছে নিচে পড়ে যাওয়ার। পায়ের স্যান্ডেল পিচ্ছিল কাদায় একাকার।

পাহাড়ে ওঠতে ওঠতে আমাদের এক সহযাত্রী রীতিমতো নিচে পড়তে যাচ্ছিলেন। পা পিছলে গেছে তাঁর। সৌভাগ্যবশত, তিনি একটি গাছ আঁকড়ে ধরে নিজেকে রক্ষা করেন। এ পথ পাড়ি দিতে দিতে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, দুটি জোঁক আসন গেড়ে রক্ত খাচ্ছে। কিছু করার নেই। জোঁক ধরবেই। ঘাম ঝরছে, ঝরছে রক্তও।

এভাবে পাহাড়ে ওঠার কিছুক্ষণ পর ধানক্ষেতের দেখা মিলল। ক্ষেতের ডানপাশে এক হাতেরও কম জায়গাজুড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তার ডান পাশে নিচে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে সেই রাস্তা হয়ে গেছে পিচ্ছিল। তাই খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল। একটু এদিক সেদিক হলেই পড়তে হবে পাহাড়ি খাদে।

এরপর সেই জুম ঘরের দেখা মিলল। যেখানে আমাদের ব্যাগগুলো রেখে লুং ফির ভা দেখতে গিয়েছিলাম। শরীর আবার ভীষণ ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। জুম ঘরে এসেই শুয়ে পড়েছি। গাইড তাড়াতাড়ি বলে দিলেন, ‘এখনি রওনা দিতে হবে।’ অথচ, আমাদের শরীর আর চলছে না। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি জোঁকের কামড়ে রক্ত ঝরছে। রক্ত বন্ধ করতে পারছি না। ক্লান্ত শরীরে মনে হচ্ছে, আজকের রাত সুন্দর এই জুমঘরেই কাটিয়ে দেই। কিন্তু গাইডের হুঁশিয়ারি, ‘জুমঘরে থাকা যাবে না, যেভাবেই হোক সন্ধ্যার আগে পাড়ায় যেতে হবে।’

রওনা দেওয়ার আগে আবার বৃষ্টির শুরু। গাইডকে বললাম, ‘বৃষ্টি একটু থামুক। তারপর রওনা দিই।’ কিন্তু, তিনি শুনলেন না। টিমের কয়েকজনকে নিয়ে রওনা দিয়ে দিলেন আগেভাগে। পেছনে আমি আর রনী ভাই। এদিকে রনী ভাইয়ের পক্ষে ভারী ব্যাগ নিয়ে সালৌপি পাড়ায় যাওয়া সম্ভব না। জুমঘরে ছিলেন ওই পাড়ার একজন গাইড। অনেক অনুরোধের পর তিনি রনী ভাইয়ের ব্যাগ কাঁধে তুলে নিলেন। আর আমি ব্যাগে থাকা নতুন পঞ্চ টাইপের রেইনকোট পরে নিলাম। কারণ, বৃষ্টি থেকে ব্যাগে থাকা কাপড়চোপড়, পাওয়ার ব্যাংক ও খাবার রক্ষা করতে হবে।

গাইডের কথা অনুযায়ী পাড়ায় পৌঁছাতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগার কথা। আমরা হেঁটে চলেছি দুর্গম একটি পথ ধরে। মাঝপথে ছোট্ট একটি খালের দেখা। যদিও খালটার নাম জানা যায়নি। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। পথ পিচ্ছিল। বারবার পায়ের দিকে তাকাচ্ছি। হঠাৎ দেখি, দুটি জোঁক পায়ে লেগে আছে। জোঁকে ধরা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে জোঁকের চিন্তা বাদ দিয়েছি। কারণ, আমরা যে পথে হেঁটে চলেছি, জোঁকের কামড় ছাড়া এ পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব না।

জোঁক আর পা থেকে ছাড়ালাম না। বিরক্তি লাগা শুরু হয়ে গেছে। ভাবলাম, যতক্ষণ ইচ্ছে রক্ত খেতে থাকুক। পায়ে জোঁক, আমি হেঁটে চলেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, আর কতদূর? গাইড জানালেন, ‘আর একটু হাঁটেন। প্রায় এসে গেছি। এখন একটি পাহাড়ে ওঠবেন। পাহাড়ের ওপরে পাড়া। এভাবে ৩০ মিনিটের মতো লাগল সালৌপি পাড়ায় পৌঁছাতে। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু, গাইড আগেই জানিয়েছিলেন, এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে! পুরো পাহাড়ি অভিযানের অধিকাংশ সময় আমাদের দৌড়ের ওপর রাখতে সব সময় বাড়িয়ে বলছিলেন গাইড। যাতে আমরা সময়ের কথা ভেবে বেশি বিশ্রাম না নিই। কারণ, তিনি জানতেন বিশ্রাম নিলে শরীর ছেড়ে দেবে।

সালৌপি পাড়ার পৌঁছানোর আগের পথ সমতল না হলেও অনেক বেশি উঁচু-নিচু ছিল না। সন্ধ্যায় পাড়ার একদম মুখে এসে আর যেন হাঁটতে পারছিলাম না। কারণ, পাড়াটি অনেক উঁচুতে। তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল। পাড়ায় পৌঁছে খুঁজতে শুরু করি অন্য সহযাত্রীদের। কারণ, তাঁরা আমাদের আগেই পৌঁছেছেন। পাড়ার এক ঘর থেকে আরেক ঘরের দূরত্ব অনেক উঁচুতে। অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ।

সালৌপি পাড়ায় স্থানীয় গাইডের মায়ের ঘরে পৌঁছেই সঙ্গে থাকা ব্যাগগুলো রাখলাম। সে সময় একটি কাগজ ফেলে দিই বারান্দার এক পাশে। এ দৃশ্য চোখে পড়ে গৃহকর্তীর। তিনি জানিয়ে দিলেন, কাগজটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে। এ কথা শুনে মন ভালো হয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখি, পুরো পাড়াটি খুব পরিপাটি। কোথাও যেন একটি গাছের পাতাও পড়ে নেই! এরপর গোসল সেরে নিই আমরা।

গোসল সেরে খেয়াল করলাম, মাইকে জোরোশোরে গান বেজে চলেছে। হঠাৎ এক নতুন আবহ। গাইডের কাছে জানতে চাইলাম, গান কেন বাজছে? গাইড বললেন, ‘আজ পাহাড়িদের নবান্ন উৎসবের দিন। বছরে এ উৎসব একদিন উদযাপন করি আমরা। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তাঁর দয়ার জন্য, খাদ্যের জন্য, দানের জন্য। বিনা অর্থ ব্যয়ে সৃষ্টিকর্তা আমাদের খাদ্য উপহার দেন। আমরা সেই খাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করি। ফলে এ দিনটা আমাদের আরাধনা করার দিন, ধন্যবাদ জানানোর দিন।’

সালৌপি পাড়ায় কথা হয় নেইলিয়ান নামের এক কিশোরের সঙ্গে। কুমিল্লার বরইগাঁও হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। করোনার সময়ে নেইলিয়ান নিজের সালৌপি পাড়ায় ছিল। নেইলিয়ান বলছিল, ‘আজ সারা রাত আমরা গান-নাচ আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি। এ দিন একটি মহান দিন। যিঁনি আমাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখেন, আজ তাঁকে সন্তুষ্ট করার দিন।’

আমরা যে ঘরে ছিলাম, সে ঘরের মালিকের নাম লুয়াং। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা প্রায় সব খাবার পাহাড় থেকে সংগ্রহ করি। তেমন কিছুই কিনি না। এই যেমন- মারফা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ কুমড়া, কাঁচা মরিচ, বেগুন, চিচিংগা, করল্লা, কাকরোল আর জুমের চাল পাহাড় থেকেই পাই। এগুলো কে দেন? সৃষ্টিকর্তা। সবই সৃষ্টিকর্তা আমাদের দান করেন। তাই আমরা তাঁর প্রার্থনা করছি আজ।’

আমাদের থাকার ঘরের বাঁ পাশে একটি আরাধনালয় রয়েছে। সালৌপি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশে। তখন সন্ধ্যা ৭টা, আমিসহ কয়েকজন গেলাম ওই আরাধনালয়ে। গিয়ে দেখি, কয়েকজন তরুণী তাঁদের নিজস্ব ভাষার বই দেখে দেখে কী যেন পড়ছেন। সেখানে থাকা একজনের কাছে জানতে চাইলাম, কী পড়ছেন? তিনি জানালেন, এগুলো ধর্মীয় বই। কিছুক্ষণ পর দেখি, চার তরুণী মিলে গান গেয়ে চলেছেন তাঁদের বম ভাষায়। শুধু উপাসনালয়ে নয়, পুরো পাড়ার নানা স্থান থেকে রাতভর বম ভাষার গান বেজে চলেছে। শোনা গেছে প্রার্থনার শব্দ।

পাহাড়িদের এ উৎসব খুব ভালো লাগছিল। সম্পূর্ণ নতুন এক উৎসব দেখার সৌভাগ্য হলো আমার। এ দৃশ্য সংরক্ষিত থাকা উচিত মনে হলে মুঠোফোন দিয়ে ছবি তুলতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় একজন বলে উঠলেন, ‘দাদা, আপনারা বসতে পারবেন। সবকিছু দেখতে পারবেন। কিন্তু ছবি তুলতে পারবেন না!’

আর ছবি তোলার চেষ্টা করিনি একবারও। এর আগে গাইড আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, পাড়ার কেউ যেন আমাদের ওপর বিরক্ত না হন। বিরক্ত হলে কিন্তু বিপদে পড়ব। ফলে আমরা অনুষ্ঠান উপভোগ করে আস্তে ধীরে উঠে এলাম।

সারাদিনের ক্লান্তি আর মুগ্ধতা শেষে রাতের খাওয়ার পর্ব সারলাম। হঠাৎ মনে হলো, সারাদিন ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। একজনের কাছে জানতে চাইলাম, কোথাও কি নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না? তিনি জানালেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে, নাও যেতে পারে। চলে গেলাম সেখানে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখে নিলাম, কেউ আছেন কি না। গাইড জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওখানে কেউ থাকলে আপনারা দাঁড়াবেন না।

সালৌপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওখানে গিয়ে মাকে কল দিলাম। প্রথমবারই কল ঢুকলো। মনে হলো, শান্তি পেলাম। অথচ, মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মতো কথা শোনা গেল। তারপর কলটি কেটে গেল! বলারও সুযোগ পাইনি, তোমার ছেলে ভালো আছে মা। চিন্তা করো না। এরপর বহুবার চেষ্টা করেও কল যায়নি। পাহাড়ি অভিযান শুরুর আগে মা বারবার বলে দিয়েছিলেন, নেটওয়ার্ক পেলেই যেন তাঁর সঙ্গে কথা বলে কলিজাটা আগে ঠাণ্ডা করি! ভীষণ অস্থির লাগছে আমার। নিজের কাছে বারবার নিজেই প্রশ্ন করছি, সমস্যা জেনেও কেন আমি কল দিতে গেলাম? মন ভার করে শোয়ার ঘরে গেলাম। ভাবছি, না জানি কেমন অস্থিরতায় আজ রাত কাটবে মায়ের! এসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, নিজেই জানি না।