পুঠিয়া রাজবাড়িতে একদিন

Looks like you've blocked notifications!
রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ি। ছবি : লেখক

বাংলাদেশের ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ি। রাজশাহী থেকে নাটোরগামী বাসে চড়ে বসলাম আমরা। এরপর পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই মিলল নসিমন। নসিমনে চেপে আমরা এগিয়ে গেলাম রাজবাড়ির পথে। পুঠিয়া বাজারে প্রবেশ করতেই হাতের বাঁ-পাশে শিবসাগর দীঘির দক্ষিণ পাড়ে বড় শিবমন্দিরের দেখা পেলাম।

কারুকার্যময় শিবমন্দির, সঙ্গে দীঘির পাড়ের নির্মল বাতাস। উঁচু মঞ্চের ওপর নির্মিত মন্দিরটির দক্ষিণ দিকে আছে সুপ্রশস্ত সিঁড়িসহ প্রধান প্রবেশপথ। চারপাশে টানা বারান্দায় রয়েছে পাঁচটি করে খিলান প্রবেশপথ। বারান্দার পিলারগুলোর নিচের অংশ চমৎকারভাবে অলংকৃত এবং মেঝের বহিরাংশে বেলেপাথর স্থাপিত আছে। মন্দিরের মূল কক্ষের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ রয়েছে, যেখানে বেলেপাথরের চৌকাঠ ব্যবহৃত হয়েছে এবং চৌকাঠগুলো ফুল আকৃতির নকশা দ্বারা অলংকৃত। প্রত্যেক প্রবেশপথের দুই পাশে চুন-সুরকি দ্বারা নির্মিত দেবদেবীর দণ্ডায়মান মূর্তির দেখা পেলাম আমরা।

উত্তর পাশে অবস্থিত দীঘিতে নামার জন্য বাঁধানো ঘাট। এই ঘাটে ওঠানামার জন্য পৃথক সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে। চতুষ্কোণাকৃতির কাঠামোর ওপরে পিরামিড আকৃতির চূড়াগুলো নির্মিত হয়েছে। পুঠিয়ায় অবস্থিত মন্দিরগুলোর মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। পাঁচআনি জমিদার বাড়ির রানি ভুবনময়ী দেবী এ মন্দির নির্মাণ করেন। তাই এ মন্দিরকে ভুবনেশ্বর মন্দিরও বলা হয়ে থাকে। বড় শিবমন্দির থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে জগন্নাথ মন্দির অবস্থিত। এ মন্দিরটিতে পোড়ামাটির কোনো ফলক না থাকলেও এর নির্মাণশৈলী বেশ চমৎকার। উত্তর ও পূর্ব পাশে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ।

প্রবেশপথে বেলেপাথরের চৌকাঠের ওপর চমৎকার অলংকরণ আছে। দোতলার কক্ষটি আকারে ছোট এবং এটির চারপাশে উন্মুক্ত প্রবেশপথ আছে। পুঠিয়া বাজারের মধ্যে অবস্থিত চার তলাবিশিষ্ট মন্দিরটি দোলমঞ্চ আকারে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে ওপরে উঠে গেছে।

এরপর আমরা গেলাম পুঠিয়া পাঁচআনি জমিদার বাড়ির অঙ্গনে অবস্থিত গোবিন্দমন্দিরে। রাজবাড়ির নিচের অংশের একটা সুপ্রাচীন দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম আমরা। লোকসমাগম একদম খারাপ না। নিয়মিত পূজা-অর্চনা হয় বোঝা গেল। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে আছে একটি কক্ষ, চার কর্নারে আছে চারটি বর্গাকৃতির ছোট কক্ষ। মন্দিরের পিলার ও দেয়াল অসংখ্য পোড়ামাটির চিত্রফলক প্যানেল দ্বারা সজ্জিত। মন্দিরগাত্রের সর্বনিম্ন স্তর ফুলেল ফলক এবং এর ওপরের সারিতে হাতি, ঘোড়া, পালকি, তীর-ধনুকসহ মোগল আমলের শিকারের বিভিন্ন দৃশ্য পোড়ামাটির চিত্রফলকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মন্দিরের পশ্চিম দিকের প্রবেশপথের ওপরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং রাম-রাবণের যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

চিত্রফলকগুলো দেখে কান্তজির মন্দিরের কথা মনে পড়ে গেল। আমরা এলাম রাজবাড়ির মূল ভবনের সামনে। শুধু কাছারি অঙ্গনের উত্তর ও পশ্চিমের দ্বিতলবিশিষ্ট দুটি ব্লক ব্যতীত প্রাসাদটির অন্যান্য অংশ একতলা আকারে নির্মিত। এ প্রাসাদ নির্মাণে উপকরণ হিসেবে ইট, চুন-সুরকি, লোহা ও কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। কাছারি অঙ্গন ও মন্দিরের অঙ্গনে প্রবেশের জন্য রাজবাড়ির সম্মুখে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে রয়েছে দুটি সুউচ্চ ফটক। আমরা একে একে ঘুরে দেখলাম চারআনি রাজবাড়ি, বড় আহ্নিকমন্দির, ছোট গোবিন্দমন্দির, গোপালমন্দির। পুঠিয়ার নিদর্শনগুলো দেখার সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে, সব নিদর্শনই কাছাকাছি জায়গায় অবস্থিত। যেকোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে ঘুরলেই আমার মনের ভেতর বিষাদ ভর করে। পুরাকীর্তিগুলো ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয় জীবন কত ক্ষণস্থায়ী।

যাওয়ার উপায় :

ঢাকা থেকে রাজশাহী

ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে রাজশাহী যাওয়া যায়। সড়কপথে ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে বাসে উঠতে হবে। এজন্য গ্রিন লাইন, দেশ ট্রাভেলস, শ্যামলী ও হানিফসহ বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস রয়েছে। শ্রেণিভেদে ভাড়া পড়বে ৪০০ থেকে এক হাজার টাকা। রেলপথে যাওয়ার জন্য রয়েছে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ও পদ্মা এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন। রোববার ব্যতীত প্রতিদিন দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং মঙ্গলবার ব্যতীত প্রতিদিন রাত ১১টা ১০ মিনিটে কমলাপুর থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া শ্রেণিভেদে ৩৫০ থেকে এক হাজার ৮১ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া আকাশপথে ঢাকার শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইউনাইটেড এয়ার ও ইউএস-বাংলা এয়ারের বিমানে রাজশাহী যাওয়া যায়।

রাজশাহী থেকে পুঠিয়া

পুঠিয়ার দূরত্ব রাজশাহী থেকে ৩৪ কিলোমিটার এবং নাটোর থেকে ১৮ কিলোমিটার। রাজশাহী থেকে নাটোরগামী বাসে চড়ে বা লোকাল বাসে করে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কের পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট হাঁটলেই পুঠিয়া রাজবাড়ি।