বাংলাদেশের বেয়ার গ্রিলস ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যান’ সালমান

Looks like you've blocked notifications!

দুর্গম পাহাড়, বন-জঙ্গল আর রোমাঞ্চকর পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন শিশির সালমান। তাঁর দেখা মেলা ভার। খোঁজ নিলে জানা যাবে, কোনো দুর্গম অঞ্চলে তাঁবু গেড়েছেন, পড়ে রয়েছেন গহীন অরণ্যে, অথবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে লড়ে টিকে থাকার উপায় খুঁজছেন। আর এসব দুর্গম অঞ্চল, দূর-দূরান্তের এলাকা শুধু যে ঘুরেই বেড়ান তা নয়, সেগুলো ক্যামেরায় ধারণ করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দেন তিনি। আর এ কারণেই তিনি হয়ে উঠেছেন অ্যাডভেঞ্চার ম্যান।

বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার-ব্যবহার, পরিবেশ-পরিস্থিতির বিস্তারিত ক্যামেরায় ধারণ করে রাখেন সালমান। এতে করে ঘরে বসেই সালমানের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা জানতে পারেন দর্শক। এরই মধ্যে সালমানের টিম অ্যাডভেঞ্চার ম্যান-এর দারুণ সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির পর্দায় তুলে ধরা হচ্ছে বহুদিন থেকেই। দর্শকপ্রিয়তা পেতে পেতে অ্যাডভেঞ্চার ম্যান-এর শো গিয়ে পৌঁছেছে ৫৮৬ পর্বে।

সালমানের গ্রামের বাড়ি যশোরের সদর উপজেলার নোয়াপাড়ায়। তবে সেখানে বেশিদিন থাকা হয়নি তাঁর। এরই মধ্যে যখন সালমান ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলেন, কোনো এক ভূত চেপেছিল তাঁর মাথায়। কাউকে কিছু না বলে একাই বেরিয়ে পড়েছিলেন সিলেটের উদ্দেশে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে কিশোর বয়সেই বাংলাদেশের অনেক এলাকা চষে বেড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন যেন এতেও নেশা কাটে না তাঁর। এমন সব দুর্গম এলাকা ঘুরে এসেছেন, যেখানে আর কারো পায়ের ছাপ পর্যন্ত পড়েনি। সালমানের মনে হলো, এত সব এলাকা ঘুরে বেড়ান তিনি, এত-এত অভিজ্ঞতা, কিন্তু কেউ তা জানতে পারছে না। মানুষকে এসব অভিজ্ঞতার কথা জানাতেই সালমান হাতে নিলেন ক্যামেরা আর কয়েকজন সঙ্গী।

২০০১ সাল, ক্যামেরা হাতে সালমানের যাত্রা শুরু। বন্ধুর কাছ থেকে ধার করলেন ট্রাভেল ব্যাগ, ক্যামেরা আর বিভিন্ন সরঞ্জামাদি। কিন্তু একের পর এক দুর্গম এলাকা, পাহাড়-পর্বত ঘুরে ক্যামেরায় ধারণ করা, থাকা-খাওয়ার অর্থের জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে সালমানের পক্ষে। এর-ওর কাছ থেকে ধার নিয়ে আর কতদিন? এমন পরিস্থিতিতে ২০০২ সালে সালমান পাশে পেলেন বিশ্বজিৎ নামের এক ব্যক্তিকে, যিনি সালমানের এমন আগ্রহ দেখে বিনা দ্বিধায় হাতে তুলে দিলেন ৩০ হাজার টাকা। তা দিয়ে সালমান আর তাঁর সঙ্গীরা কিনলেন ঘুরে বেড়ানোর রসদ।

সালমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘তাঁকে (বিশ্বজিৎ) আমরা দুলাভাই বলে ডাকি। তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তা আমরা সারা জীবন মনে রাখব। এখন পর্যন্ত উনি আমাদের পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা দিয়েছেন। কথা হয়েছিল, এসব ভিডিও থেকে যদি কখনো আমরা উপার্জন করতে পারি, ৫০ শতাংশ করে তাঁকে দেব। কিন্তু কখনোই তিনি আমাদের কাছ থেকে টাকা চাননি, নির্দ্বিধায় দিয়ে গেছেন। আমরা নিজেরাই অল্প অল্প করে তাঁকে ফেরত দেই।’

শুরুতে সুন্দরবনকে ক্যামেরায় ধারণ করেন সালমান। এরপর একে একে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলও ধারণ করেন তিনি। যান বান্দরবানের আন্ধারমানিক, পুকুরপাড়া, রাঙামাটির দুমলং পাহাড়ের চূড়াসহ বিভিন্ন জায়গায়। এসব অঞ্চলে অনেক আগে একাধিকবার পা ফেললেও পরে আরো বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। তিনি চাইতেন, এসব এলাকার ভিডিও টিভি চ্যানেলে দেখানো হোক। কিন্তু আনাড়ি হাতের এসব ভিডিও তেমন কারো মনে দাগ কাটতে পারেনি। তবে তাঁদের এমন আগ্রহ দেখে সামনে এগিয়ে যেতে বলেন অনেকেই।

সালমান স্মরণ করলেন বেয়ার গ্রিলসকে, ডিসকভারির ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ শো দিয়ে যিনি তুমুল জনপ্রিয়। বেয়ার গ্রিলসকে গুরু মেনে সালমান হাল ছেড়ে দেননি, বরং এগিয়ে গেছেন।

এরই মধ্যে সালমানের সঙ্গী হয়েছেন আরো ছয়জন। তাঁদের নিয়ে তৈরি করলেন একটি দল—তিন জন চালান ক্যামেরা, আর তিন জন সহযোগী। দলটিকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন সালমান। কিন্তু এই দলে সবাইকে নেওয়া সম্ভব নয়। দরকার এমন সব মানুষকে, যাঁরা মাঝপথে সরে যাবেন না। অনেকে ভালো ক্যামেরা চালাতে পারেন। কিন্তু দুর্গম অঞ্চলে ক্যামেরাগিরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে টিকে থাকতে হবে এসব এলাকায়। সালমানের এই দলে রয়েছেন এমন ব্যক্তিরা, যাঁদের একজন রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আরেকজন ছিলেন জেলে। নৌকায় করে মাছ ধরে বেড়াতেন তিনি।

এমনই একজনের নাম বাবু। চাঁদপুরের নদীতে মাছ ধরতেন তিনি। চাঁদপুর বেড়াতে গিয়ে সালমানের চোখে ধরা পড়েন। সালমান ঢাকায় নিয়ে আসতে চান বাবুকে, দলে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু বাবুর চোখেমুখে সংকোচ। জানালেন, লেখাপড়া নেই তাঁর। কিন্তু নাছোড়বান্দা সালমান কিছুতেই হাল ছাড়তে চান না। একপর্যায়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন বাবুকে। তিন মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্যামেরা চালানো শেখান। এরপর বাবু হয়ে গেলেন দলের অন্যতম সদস্য।

সালমান বললেন, ‘ওকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, অনেক কর্মঠ আর সৎ। আমি তাঁকে দলে নিতে চাইলাম। কারণ, আমার দলে এমন মানুষেরই প্রয়োজন ছিল।’

২০১২ সালে এনটিভিতে শুরু হয় সালমানের ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যান’ নামের শোটি। টেলিভিশনের মাধ্যমে সালমান দেখাতে থাকেন বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চল, সেখানকার মানুষদের আচার-আচরণ, সংস্কৃতিকে। এরই মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ‘অ্যাডভেঞ্চার ম্যান’। এনটিভিতে একে একে ৫৮৬ পর্ব পার করেছে সালমানের এই শো। আরো অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার আশা তাঁর।

সালমানের কাছে দর্শকের চাহিদা অনেক। তাই সালমানকে এখন ঘুরে বেড়াতে হয় আরো নতুন নতুন এলাকায়। তাঁর দলও এখন ভারী। বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় গিয়ে পড়তে হয় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায়। টিকে থাকতে হয় জীবন-মৃত্যুর সন্নিকটে। কখনো খাবার মেলে না। কখনো বা একবেলা সামান্য খেয়ে দিন পার করতে হয়।

সালমান বললেন, ‘এমনও দিন গেছে এক কাপ চা খেয়ে আমরা সারা দিন পার করেছি। কখনো পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে থেকে তাঁদের সহযোগিতা পেয়েছি। এমন সব খাবার খেতে হয়েছে, যা খাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের দলটা এভাবেই তৈরি। যেৱকোনো পরিস্থিতিতে আমরা মানিয়ে নিতে পারি।’

সালমানের গ্রামের বাড়ি যশোরের নোয়াপাড়া এলাকায়। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। এ ছাড়া কোনো ভাইবোন নেই তাঁর। মায়ের সঙ্গে থাকেন রাজধানীর মিরপুর এলাকায়। মা-ই তাঁর সব। প্রকৃতিপ্রেমী সালমান অনেক খুঁজে মিরপুরে একটি বাসা পেয়েছেন, যার চারপাশে গাছগাছালি আর পাখির কলতান। বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশেই সালমানের বাসা। বোটানিক্যাল গার্ডেনের অসংখ্য গাছ দেখা যায় সালমানের বাসার জানালা খুললেই।

বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় যাওয়ার বিশদ পরিকল্পনা রয়েছে সালমানের। এরই মধ্যে নেপাল সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন আমন্ত্রণ। নেপাল সরকার চায়, তাঁদের দেশও উঠে আসুক অন্য দেশের দর্শকের সামনে। আর সালমানের পরিকল্পনা, অন্যান্য দেশের বিভিন্ন এলাকা দেখিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন করতে হবে এই বলে যে, ওরা এত সুন্দর করে তাঁদের দেশের সবুজ অঞ্চল সাজাতে পারলে আমরাই বা পারব না কেন।

নেপালের এভারেস্টের আশপাশ, আপার মুস্তাং, লোয়ার মুস্তাংসহ বিভিন্ন এলাকা ক্যামেরায় ধারণ করবেন সালমান। এরপর চীন, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা তাঁর। এ ছাড়া ২০২০-২১ সালের দিকে ব্রাজিলের আমাজনে যাওয়ার ইচ্ছেও রয়েছে তাঁর।

বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ। দুর্গম এলাকা খুব একটা নেই, তাঁর ওপর ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চল আর বন্য প্রাণীরা। সালমানের ভয়, এভাবে চলতে থাকলে একসময় কোনো বনাঞ্চলই থাকবে না বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের প্রকৃতির হালচাল জানতে চাইলে সালমান বলেন, ‘আগে যেসব এলাকায় আমরা যেতাম, এখন সেসব এলাকার রাতদিন পার্থক্য। আগে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী যেমন—হাতি, গয়াল, বন্য শূয়র, হনুমান, নানা প্রজাতির সাপ, বানর, ভাল্লুকসহ অনেক পশুপাখি দেখা গেলেও এখন চেষ্টা করেও খুব একটা দেখা যায় না।’

এর কারণ জানতে চাইলে সালমান জানান, মানুষ বন উজাড় করে ফেলছে, পাথর উত্তোলন করছে, পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে, ধীরে ধীরে বনাঞ্চল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বনাঞ্চল না থাকলে প্রাণীরাই বা থাকবে কীভাবে? এভাবে চললে ১০ বছর পর বনাঞ্চলের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে।

বনাঞ্চল বাঁচিয়ে রাখতে কী করণীয় জানতে চাইলে সালমান বলেন, ‘এটা একদমই কঠিন কাজ নয়। বনাঞ্চলের কোনো ক্ষতি না করলেই হবে, একা ছেড়ে দিতে হবে। আমরা যদি গাছপালা না কাটি, পাথর উত্তোলন না করি, পাহাড় কেটে না ফেলি; তাহলে গাছপালা থেকে নতুন করে গাছপালার জন্ম হবে। বনাঞ্চলে গিয়ে আমাদের গাছ লাগাতে হবে না। বনাঞ্চলের গাছের বীজ থেকেই নতুন নতুন গাছ জন্মাবে। আমাদের শুধু বনাঞ্চলের ক্ষতি না করলেই হবে। এমন হলে ধীরে ধীরে প্রাণীরাও আসতে শুরু করবে।’

যাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বেড়াতে যান, তাঁদের উদ্দেশে সালমানের আহ্বান, ‘কোথাও বেড়াতে গেলে অবশ্যই পলিথিন ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া জোরে শব্দ করা থেকেও বিরত থাকতে হবে, না হলে প্রাণীয় ভয় পায়, এলাকা থেকে সরে যায়।’

এ ছাড়া কোনো দুর্গম অঞ্চলে গেলে অবশ্যই ওই অঞ্চল সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। ওই অঞ্চলের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে না জানলে বড় ধরনের বিপদও ঘটে যেতে পারে। পরিবেশ-পরিস্থিতি ও নিজের শরীরের সক্ষমতার সামঞ্জস্য রেখে যেতে হবে দুর্গম এলাকায়। এসব না মানার কারণে বাংলাদেশে দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানালেন সালমান।

নিজের শরীরকে ঠিক রাখতে সালমান নিয়মিত ১০ কিলোমিটার হাঁটেন। তিনি বলেন, ‘কখনো যদি হাঁটতে না পারি, অন্যদিন বেশি করে হেঁটে তা পূরণ করে দেই। কারণ, আমরা যেসব জায়গায় যাই, সেসব জায়গায় শরীর ফিট রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’