মেঘ বৃষ্টি আলোর দেশে

Looks like you've blocked notifications!

আজ এক মেঘরাজ্যের গল্প করব। যেখানে ভোর হলে ঘরের দরজা খুললেই মেঘ এসে ঢোকে। বৃষ্টি এখানে ভীষণ খামখেয়ালিপনায় ভিজিয়ে দিয়ে যায় যখন-তখন। উঁচু-নিচু রাস্তা আর চারদিকের সবুজ পাহাড় সবচেয়ে রসকষহীন মানুষকেও উদাস করে দেয়। হ্যাঁ, বলছি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী চেরাপুঞ্জির কথা, যার স্থানীয় নাম সোহরা।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেক দিনের। উদ্দেশ্য, পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের শহর হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসা চেরাপুঞ্জি দেখা আর সঙ্গে খাসি জীবনধারা উপভোগ করা। ভ্রমণে ডাউকি, সোহরা, শিলংসহ আশপাশে নানা জায়গায় ঘুরলেও এই লেখায় আজ কেবল আমার স্বপ্নের শহর সোহরা নিয়েই লিখব। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন, এ শহরের অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা আসলে কোনোদিন ভুলতে পারব না।

আমাদের সিলেটের সীমান্তবর্তী ডাউকি শহর থেকে সোহরার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। সীমান্তের নানা ঝক্কি পেরিয়ে গতকাল এসে পৌঁছালেও কাল মূলত ডাউকি আর মাওলিনং গ্রামেই কেটেছে সারা দিন। আজকের মূল পরিকল্পনা সোহরা ঘিরেই। খুব সকালেই ঘুম ভাঙল ট্যুরমেটদের ডাকাডাকিতে। দরজা খুলতেই দেখি বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর ঘোলাটে মেঘের আনাগোনা। এ এক স্বর্গীয় সকাল যেন। দলের অন্য সদস্যদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে উঠে ফ্রেশ হতে শুরু করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ আমরা ঘুরে দেখব চেরাপুঞ্জির আশপাশের কিছু বিখ্যাত ফলস ও ন্যাশনাল পার্ক। সবাই রেডি হওয়ার ফাঁকেই ট্যুরমেট মামুন ভাই, ভাবি, প্রিয়াঙ্কাসহ হোমস্টের সামনের রাস্তা ধরে কিছু দূর ঘুরে আসলাম। এখানকার প্রত্যেক বাড়ির ডিজাইন এত অনন্য আর নান্দনিক যে মুগ্ধ হতে হয় রুচিবোধ দেখে। আর প্রায় সব আঙিনাতেই চোখে পড়ে ঝকঝকে ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি। রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোতে পানি আছড়ে পড়ার প্রবল শব্দ অনুসরণ করতে গিয়ে দেখি এক বিশাল ঝিরি। সেখান থেকেই আসছে শব্দ। কিছুক্ষণ দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আবার আচমকা বৃষ্টি শুরু হলে দ্রুত ফিরে এলাম হোমস্টের দিকে। মেঘালয়ের বিশেষত্বই এই, যখন-তখন বৃষ্টি। তাই মেঘালয় ভ্রমণের পরিকল্পনায় ছাতা, রেইনকোর্টসহ বৃষ্টিতে ভেজার আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি অবশ্যই থাকতে হবে।

রুমে ফিরে দেখি সবাই মোটামুটি রেডি। যেহেতু আজ রাতেও আমাদের এখানেই থাকার পরিকল্পনা, তাই আর ব্যাগ টানাটানির ঝামেলা নেই। রিজার্ভ গাড়িতে উঠে রওনা হয়ে গেলাম সেভেন সিস্টার্স জলপ্রপাতের আপার স্ট্রিম এলাকায়। অল্প সময়েই পৌঁছালাম পার্কের গেটে। মেইন গেটের পাসে গেস্ট হাউসের নিচতলাতেই ক্যাফে রয়েছে। সেখানেই নাশতার অর্ডার করা হলো। তৈরি হতে যে সময়টুকু লাগল, ততক্ষণে বেশ গল্প হলো সবাই মিলে। নাশতা চলে আসলে গপাগপ খেয়ে চা হাতে নিয়ে সবাই বের হলাম রেস্টুরেন্টের বাইরে। চারপাশে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। যেকোনো সময় শুরু হয়ে যাবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মেঘালয়ে এসে মেঘ মিশিয়ে চা পান না করলে কী আর জমে!

চা-নাশতা পর্ব শেষ হতেই সবাই বের হলাম পার্ক এলাকা ঘুরে দেখতে। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় রেইনকোটের আশ্রয় নিতে হলো। এখানে কিছু কৃত্রিম অ্যামিউজমেন্টের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া একটা ভিউ পয়েন্টও আছে। পুরো এলাকা ঘুরে দেখতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। অতঃপর গাড়িতে গিয়ে বসলাম মেঘালয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন স্পট সেভেন সিস্টার্স জলপ্রপাত দেখার উদ্দেশ্যে।

মিনিট দশেকেই পৌঁছালাম ভিউ পয়েন্টে। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে হতাশ হতে হলো মেঘের কারণে পুরো ফলসের ভিউ ঢেকে থাকায়। বলা বাহুল্য, মেঘালয়ে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। তাই বৃষ্টির মৌসুমে গিয়ে সব স্পট দেখতে পারা কিছুটা ভাগ্যের ব্যাপারও বটে।  কিছুক্ষণ অপেক্ষাতে সৌভাগ্যক্রমে সামনের অংশ কিছুটা পরিষ্কার হলে দেখা মিলল মেঘালয় রাজ্যের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত সেভেন সিস্টার্সের। এখানে মূলত পুরো পাহাড়ের গায়েই পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকটি ঝর্ণা চোখে পড়ে, তবে নিশ্চিত না আসলেই ঠিক সাতটা কি না। এর মধ্যেই মেঘের আনাগোনা চলতে থাকল। হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলে আমরা রওনা হলাম থানকারাং পার্কের দিকে।

পৌঁছাতে বেশ সময় লেগে গেল রাস্তা খারাপ হওয়ায়। এত খারাপ রাস্তা এ পর্যন্ত মেঘালয়ে আর পাইনি। অবশেষে পৌঁছালাম থানকারাং পার্কে। এন্ট্রি ফির পাশাপাশি ক্যামেরার জন্যও চার্জ দিতে হলো। পরে দেখেছি এটা মেঘালয়ের প্রায় সব ট্যুরিস্ট স্পটেরই নিয়ম। খুব বেশি বড় না পার্ক এলাকা। বৃষ্টির মধ্যেই সবাই মিলে ফটোসেশন হলো কিনরেম ফলস ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে বাংলাদেশের সিলেটাঞ্চলের বিস্তীর্ণ হাওড়ের জলরাশির কিছুটা চোখে পড়ে। কিনরেম ফলস বেশ অনেকটা দূর থেকে দেখেই সন্তুষ্ট হতে হয়।

থানকারাং পার্ক থেকে বের হয়ে সেই ভাঙা রাস্তা ধরে চললাম মোসমাই কেভের দিকে। সোহরা থেকে মোসমাইয়ের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে কৃত্রিম লাইট আর প্রচুর জনসমাগম গুহা ঘুরে দেখার আনন্দকে ম্লান করলেও ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে এমনটাই আসলে হওয়ার কথা। পুরো গুহার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ মিটার। এক্সিট পয়েন্ট দিয়ে বের হয়ে এলাম নানান কসরত করে।

ইতোমধ্যে সবাই বেশ ক্ষুধার্ত দেখে আর দেরি না করে মোসমাই কেভের কাছেই এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের ভুড়িভোজ হলো। ইন্ডিয়ান থালি স্বাদে খুব আহামরি না হলেও ভেতো বাঙালির ভাতেই যত সুখ। খাওয়া-দাওয়া শেষে আবার রওনা হলাম মেঘালয়ের আরেকটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান নোহকালিকাই ফলসের দিকে।

মেঘালয়ের সবচেয়ে সুউচ্চ জলপ্রপাত সম্ভবত নোহকালিকাই। প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী, কালিকাই নামের এক মেয়ে জলপ্রপাত থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করাতে তার নামানুসারেই এর নামকরণ। এখানে এসেও বিধি বাম। মেঘের খামখেয়ালিপনায় জলপ্রপাতের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝতে পারলাম সুন্দরী আজ আর দেখা দেবে না। আগামীকাল চেরাপুঞ্জি ছাড়ার সময়-সুযোগ হলে আরেকবার চেষ্টা করা যাবে, এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরতিপথ ধরলাম। যদিও পরে দিন সৌভাগ্যক্রমে দেখা হয়েছিল।

আজকের দিনের শেষ গন্তব্য ডায়ানথান ফলস। শেষ বিকেলে পৌঁছালাম ডায়ানথান জলপ্রপাতের সামনে। খুব সুন্দর জলপ্রপাত হলেও এই প্রথম কোনো ট্যুরিস্ট স্পটে অবহেলার ছাপ চোখে পড়ল। এখানে আসলে দেখভাল করার কোনো কর্তৃপক্ষ চোখে পড়েনি। এইটা মূলত আপার স্ট্রিম। এখান থেকে পানি নিচে ঝরে পড়ে অবিরত। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

পরের সকালের গন্তব্য ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহ্যবাহী শহর শিলং। মেঘালয় ভ্রমণে মোটামুটি একটা সাধারণ শিডিউলেই গাড়ি রিজার্ভ করে ঘুরতে হয়। ড্রাইভাররাই মূলত গাইডের কাজ করে সেখানে। তবু নিজেদের সুবিধার্থে একটা পরিকল্পনা নিয়ে গেলে কিছুটা সুবিধা হয়। ইন্টারনেটে সার্চ করলেই মেঘালয়ের দর্শনীয় স্থানের লম্বা লিস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। একদিনে রিজার্ভ গাড়ির ভাড়া গাড়িভেদে ২৫০০-৩৫০০ হয়ে থাকে। এ ছাড়া থাকার জন্য পর্যাপ্ত হোটেল এবং হোমস্টে রয়েছে পুরো সোহরাজুড়ে। সোহরার গল্প না হয় আজ এখানেই শেষ হোক। মেঘালয় রাজ্যের অন্য কোনো গল্প নিয়ে আসব পরের পর্বে।