দিনে জলে স্নান, রাতে জ্যোৎস্নায়
এবারের বিজয় দিবসটা একটু অন্য রকমভাবে পালন করতে চেয়েছিলাম। ফেসবুকে ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম একটি ট্যুরের বিবরণ। বিজয় দিবসের ছুটিতে পূর্ণিমার আলোয় ক্যাম্পিং! তাও বাংলাদেশের নায়াগ্রা জলপ্রপাত-খ্যাত নাফাখুমের পাশে।
‘বৃত্ত…ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম’ নামের একটি ভ্রমণ দল এটার আয়োজক। বিবরণ পড়ে ভালোই লাগল। এর আগেও এভাবে ক্যাম্পিং করার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। গত নভেম্বর মাসে সুপার মুন তারা এভাবেই উপভোগ করেছিল নাফাখুমের সুধা। কিন্তু আমার কখনো তাঁবুবাসের সৌভাগ্য হয়নি। স্কুলজীবনে স্কাউট করা বন্ধুদের তাঁবু বাস করা দেখে আফসোস হতো খুব। তাই এবার আর সেই সুযোগ হারাব না বলে ঠিক করলাম। যেই কথা সেই কাজ। নির্ধারিত টাকা দিয়ে যুক্ত হলাম বৃত্তের নাফাখুম ইভেন্টের সঙ্গে।
যথারীতি সেই প্রতীক্ষার প্রহর এলো। ১৫ ডিসেম্বর রাত ১০টায় আমাদের বাস ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করল বান্দরবানের উদ্দেশে। হৈ-হুল্লোড় করতে করতে কেটে গেল সময়। ভোরে বাস পৌঁছাল বান্দরবান শহরে। সকাল ৬টায় সেখান থেকে রিজার্ভ করে মিনিবাসে রওনা হলাম থানচির দিকে। কয়েকজন উঠল বাসের ছাদে। আমি বসলাম চালকের পাশের সিটে, বান্দরবানের অপরূপ দেখব বলে। চালক জানালেন, থানচির দূরত্ব ৭৯ কিলোমিটার। সময় লাগবে চার ঘণ্টা।
পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ দিয়ে চলছিল আমাদের বাস। হাঁ হয়ে দেখছিলাম পাহাড়গুলো। নিচে তাকিয়ে দেখি এ যেন আরেক সাজেক। শুভ্র মেঘের কার্পেট দিয়ে ঢাকা। সেই মেঘ দেখতে দেখতে চলে এলাম চিম্বুক পাহাড় এলাকার ক্যান্টিনে। সেখানে কিছুক্ষণ বিরতি নিলাম সবাই। সাদা মেঘের ভেলার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন অনেকে।
সকাল সোয়া ১০টায় থানচি পৌঁছে স্থানীয় গাইড হারুন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম থানচি থানায় পুলিশের অনুমতি নিতে। অনুমতি শেষে হোটেলে ভাত, ডাল, সবজি আর মুরগির মাংস দিয়ে নাশতা সারলাম। ততক্ষণে আমাদের এই ট্যুরের লিডার আতিফ আসলাম ভাই গেলেন বিজিবি ক্যাম্পে, বাদ-বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে। সব অনুমতি শেষে দুপুর ১২টা নাগাদ থানচি ঘাট থেকে ট্রলারে করে রওনা হলাম রেমাক্রির উদ্দেশে। সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রির দিকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে হয় ইঞ্জিনচালিত এসব নৌকায় করে। ওপরে ওঠা বলছি এই কারণে যে, নদীটা রেমাক্রি থেকে থানচির দিকে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে এসেছে। আর এ কারণে এখানে খুবই স্রোত। শীতকালে পানি কিছুটা কমলেও স্রোতের দাপট রয়েছে বেশ কিছু ঢালু জায়গায়। বর্ষায় এর রূপ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, আন্দাজ করতেই গা শিউরে উঠল! নদীর কিছু দূর পরপর এক-দুই ফুট, এমনকি কোথাও কোথাও চার-পাঁচ ফুট পর্যন্ত ঢালু হয়ে নিচে নেমেছে। প্রকৃতি এখানে এত সুন্দর আর নির্মল হতে পারে ভাবাই যায় না। নদীর পানি নীলাভ সবুজ।
কোথাও শুভ্র সাদা। নদীর দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। সবুজে মোড়ানো প্রতিটি পাহাড় যেন মেঘের কোলে শুয়ে আছে অবলীলায়। কোনো কোনো পাহাড় এতই উঁচু যে তার চূড়া ঢেকে আছে মেঘের আস্তরে। অসাধারণ সে দৃশ্য! মনে হচ্ছে কোনো প্রাচীন স্বর্গে চলে এসেছি। সবুজে ঘেরা সে পাহাড়ে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় দু-একটি উপজাতিদের বসতঘর, চাষাবাদের জমি।
রেমাক্রির আগেই পড়ে ‘তিন্দু’। এই ‘তিন্দু’ সম্পর্কে শুনেছিলাম যে ‘বান্দরবান যদি বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ হয় তবে সেই ভূ-স্বর্গের রাজধানী হলো তিন্দু’! সেই কথার বাস্তব রূপ দেখতে পেলাম এবার! বড় বড় সব পাথর বোল্ডারের মতো পথ আগলে আছে। কোনোটার নাম ‘রাজা পাথর’, কোনোটার নাম ‘বড় পাথর’। স্থানীয়দের কাছে ভীষণ পূজনীয় এই জায়গা। আর এখানে নৌকা থেকে নেমে হেঁটে পার হতে গিয়েই বাঁধল ট্যুরের বিপত্তি! ট্রলারে উঠতে গিয়ে আমাদের ট্যুরের সদস্য সুমাইয়া নিসা আপু পা মচকে পড়ে গেলেন। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন পায়ে। ওনার ব্যথার অবস্থা দেখে টিম লিডার আতিফ আসলাম সিদ্ধান্ত নিলেন যে ওনাকে রেমাক্রি বিজিবির কটেজে রেখে যাবেন। কিন্তু আপু নাছোড়বান্দা। তিনি আমাদের সঙ্গে দু-তিন ঘণ্টা পথ হেঁটে নাফাখুম যাবেনই! দায়িত্ব নিলেন টিম লিডার।
এর আগে আমরা কয়েকজন রেমাক্রির শীতল জলে গোসল সেরে নিই। শুয়ে-বসে আরাম আয়েশে করি গোসল। বেলা সাড়ে ৩টায় রেমাক্রি থেকে গাইড হারুন ভাইসহ আমরা ১০ জন রেমাক্রি খাল ধরে হেঁটে রওয়া হই নাফাখুমের উদ্দেশে। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে সেখানে। বাকি আটজন ট্যুর মেম্বার আতিফ আসলামের নেতৃত্বে আসতে থাকেন আমাদের পেছনে। যেহেতু আমাদের দুই আপু (আরেক আপু তুরিন ঢাকা থেকে পায়ের ব্যথা নিয়েই আসেন) পায়ের ব্যথায় হাঁটছিলেন, তাই ওনাদের আসতে বেশ দেরি হচ্ছিল। দুই পাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। মাঝখানে রেমাক্রি খাল। খুবই সুন্দর সেই দৃশ্য। পিঠে কিছুটা ভারী ব্যাগ নিয়ে হাঁটায় মাঝেমধ্যে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মাঝেমধ্যে শীতল খালের পানি দিয়ে হাঁটায় এবং খাল পার হওয়ায় সেই ক্লান্তি চলে যাচ্ছিল নিমিষে। ঠিক সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম নাফাখুমে। হালকা আলো-আঁধারিতে সে এক অপরূপ দৃশ্য।
রেমাক্রি খালের পানিপ্রবাহ এই নাফাখুমে এসে বাঁক খেয়ে হঠাৎ করেই নেমে গেছে প্রায় ২০-২৫ ফুট। প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে চমৎকার এক জলপ্রপাত। আমরা জামা-কাপড় ছেড়ে হালকা ফ্রেশ হয়ে নিলাম, ততখনে আমাদের গাইড ভাই কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে রাতের রান্নার আয়োজন করতে বসে গেলেন। ভাত, মুরগির মাংস, আলু ভর্তা আর ডাল! সন্ধ্যা ৭টার দিকে টর্চের আলোয় টিম লিডার আতিফ আসলাম পৌঁছালেন বাকি সদস্যদের নিয়ে। তিনি এসেই আরেক টিম লিডার সাইমুন ইসলামকে নিয়ে তাঁবুগুলো সেট করে ফেললেন ঝটপট। এরপর চারপাশে বসানো হলো ক্যাম্প ফায়ার। মধ্যে জ্বলছিল কাঠের ডালপালা। সেই আলোর মধ্যে খেলাম রাতের খাওয়া। অপূর্ব!
এরপর শুরু হলো গল্প, জীবনের গল্প। কয়েকজন বসে যান কার্ড খেলতে। কেউ কেউ শুরু করে দেন গান। পাহাড় ডিঙিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠছিল চাঁদ। সেই চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতায় হানা দেয় কুয়াশা। সে এক ভয়ংকর মোহনীয় আর নেশাসক্ত পরিবেশ। এমন রাত জীবনে কখনো আসবে ভাবতে পারিনি।
কখন যে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। ভোরে উঠে দেখলাম নাফাখুমের আসল সৌন্দর্য। এ রকম নৈসর্গিক দৃশ্য আমার জীবনে আমি দেখিনি। এরপর নুডলস খেয়ে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রওনা হলাম রেমাক্রির উদ্দেশে। মনটা খুব খারাপ ছিল। নাফাখুম ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল এখানে, এই জলপ্রপাতের পাশেই থেকে যাই বাকিটা জীবন।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে বান্দরবান বাসে করে। নন এসি বাসের ভাড়া ৬২০ টাকা। বান্দরবান থেকে থানচি লোকাল বাস বা জিপ রিজার্ভ নিয়ে যেতে পারেন। গাইড ঠিক করে তাঁকে নিয়ে যেতে হবে থানচি থানা ও স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে। অনুমতি নিয়ে রিজার্ভ বোটে (পাঁচজন করে) যেতে হবে রেমাক্রি। রেমাক্রি থেকে দুই ঘণ্টার মতো হেঁটে যেতে হবে নাফাখুম।