পর্ব ০১

শীতে ঘোরাঘুরি

পাহাড় বেয়ে মনিপুরে

Looks like you've blocked notifications!

দ্বিতীয়বারের মতো বিদেশের মাটিতে পদচিহ্ন রাখব। ভাবতে বড্ড ভালোই লাগছে। তবে এবার যাচ্ছি ভারতে সেভেন সিস্টারের শেষ সিস্টার মনিপুর রাজ্যে। মনিপুরের রাজধানি ইম্পালে মনিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রনে ইন্ডিয়ান অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সোসাইটির ৪৬তম বাৎসরিক নৃবৈজ্ঞানিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন যোগ দিতে গিয়েছিলাম আমরা। প্রথমবারের মতো প্লেনে চড়ে মেঘের উপরে ভাসব বলে রোমাঞ্চকর অনুভূতিরও যেন শেষ নেই  আমাদের। মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিলাম আমরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও মনিপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রয়োজনী কাগজপত্র সংগ্রহ শেষে ভিসার জন্য আবেদন করলাম আমরা।আর যথারীতি ভিসার জন্য অপেক্ষা প্রহর গুনতে থাকলাম।

যাত্রা শুরু হলো আমাদের
সম্মেলনটা মূলত ৮ থেকে ১০ নভেম্বর হলেও প্রায় ১০ দিনের প্রস্তুতি আমাদের। আগরতলা থেকে ইম্পাল ও ইম্পাল থেকে আগরতলা বিমানের টিকেটও সংগ্রহ শেষ। ৭ নভেম্বর আগরতলা থেকে ইম্পাল আমাদের ফ্লাইট। ভিসার জন্য ৭ তারিখের ফ্লাইট মিস হলে মন খারাপ হলো। হওয়ারই তো কথা। সব মন খারাপের অবসান ঘটিয়ে ৮ নভেম্বর ভোর ৫টায় কুমিল্লা থেকে মাইক্রোবাস যোগে আখাউড়া বর্ডারে গেলাম।

ওপারে আগরতলা। বাংলাদেশ ও ভারতের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে করতে সকাল ১০টা পেরিয়ে গেল। শুনলাম, আগরতলা থেকে মনিপুরের ইম্পাল যেতে একটাই স্বাচ্ছন্দের পথ হলো আকাশ পথ। এবার তো আবারও মন খারাপের পালা। শেষে জানলাম আগরতলা থেকে সকাল ১১টায় একটা ট্রেন ছেড়ে যাবে মনিপুরের কাছাকাছি কোন স্টেশনে। অগত্যা তাড়াহুড়া করে আমরা আগরতলা রেলওয়ে স্টেশনে এসে টিকিট সংগ্রহ করে চড়ে বসতে না বসতেই ট্রেন ছুটল। আমরা এখনো জানি না, যে গন্তব্যে যাচ্ছি সেটা কতদূর ও কত সময়ের। অন্যান্য যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানলাম রাত ৮টা কি নয়টা নাগাদ পৌঁছাব আমরা। কী জ্বালা বলে কী! রাত ৯টা। ট্রেন কোনো স্টেশনে দুই মিনিটের বেশি থামে না। আর এমন কোনো স্টেশন নেই যে সেটা এই আশীর্বাদপুষ্ট ট্রেন ধরে না। সবাই অভুক্ত। মাঝেমধ্যে ঝালমুড়ি, বাদাম ইত্যাদিতেই পেটের ছুঁচগুলোকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে কয়েকজন যাত্রী কথা বলে ও সম্মেলনের আহ্বায়কের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে জানলাম মস্ত কাহিনী। কোন গন্তব্যে যাচ্ছি আমরা। যেখানে নামব সেখান থেকেও নাকি ২৬০ কিলোমিটারের পথ ইম্পাল। কী আর করা ত্রিপুরার শীলচরে নামার সিদ্ধান্ত হলো। এর মধ্যে শত ক্লান্তিতেও পাহাড়ি ছোঁয়ায় মন ভরে উঠল আমাদের। পাহাড়ের তল দিয়ে সুরঙ্গের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলছে মাঝেমধ্যে। স্টেশনগুলোর কত বাহারি নাম। সব ভুলে আমরা আনন্দ করলাম ট্রেনে। কথায় আছে ‘ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে’। বাঙালি বলে কথা, গান ও নানা হাস্যরসে মেতে ছিলাম। পুরো বগির যাত্রীরাও আমাদের সঙ্গে সায় জানাল। 

রোমাঞ্চকর যাত্রা শুরু 
১০ ঘণ্টা ট্রেনে চলার পর রাত ৯টায় ত্রিপুরার শীলচরে নামলাম আমরা। প্লাটফর্মে নেমে পিছন ফিরে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে অবচেতনভাবেই স্বগতোক্তি করলাম, ‘বেঁচে থাকিস বাবা’। এ দিকে সম্মেলনে আহ্বায়ক অধ্যাপক জীবন কুমার সিং শীলচর থেকে আমাদের জন্য মোঠোফোন যোগে একটা জিপ আগে থেকেই রেখে দিয়েছিলেন। জিপে উঠে বসলাম। এবার আবার নতুন বিপত্তি। জিপের চালক আবদুল মনিপুরী। সে না পারে হিন্দি, বাংলা বা ইংরেজি। একটু আধটু হিন্দি বোঝে বলে একটু বাঁচা গেল। কিন্তু তার কথা তো আমরা বুঝব না। খাওয়া দরকার এমনটি বুঝালে ও একটা দোকানের সামনে জিপ দাঁড় করাল রাত ১২টার একটু আগে। দোকানি বউকে উঠিয়ে রান্না করতে গেল ভাত। আমার বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সারাদিন না খাওয়া শুনে তিনি গরম খাবারের ব্যবস্থা করলেন। সারাদিন ও রাতের বেশির ভাগ সময় অভুক্ত থেকে খাবার পেয়ে তাও আবার গরম ভাত, ঝোল করা রুই মাছ আর ডাল যেন মরুভূমিতে একটু সবুজের ছায়া। সবাই খেলাম পেট পুরে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে রুপি দিতে গিয়েই জানলাম নরেন্দ্র মোদির ফন্দি। ৫০০ ও এক হাজার রুপির নোট বাজার থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু আমাদের কাছে তো পাঁচশ ও এক হাজার রুপির নোট ছাড়া নেই। দোকানি আমাদের অবস্থা বুঝে নিয়ে রুপি নিল তার হিসেব মতো।

আমরা আবারও পথ চলতে শুরু করলাম। এখান থেকে ইম্পাল নাকি ২৬০ কিলোমিটার। মনে করেছিলাম কত সময় আর লাগবে যেহেতু জিপ আমাদের জন্যই সেহেতু ঘণ্টা সাতেক লাগতে পারে। কিন্তু এ চিন্তা আমাদের চরমভাবে ভুল প্রমাণিত হলো পরের দিন। যাহোক আমরা চললাম। রাস্তার সেকি অবস্থা। ঘন কুয়াশার চেয়েও ঘন শুকনো ধুলা। একটা রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যের যোগাযোগের প্রধান সড়কের এই হাল সত্যিই আমাদের অবাক করে দিয়েছে। কতকাল আগে এ রাস্তায় মেরামতের তোর জোর চালানো হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। রাস্তায় চলে যেন সাগরে ভাসার স্বাদ পাচ্ছিলাম। 

আজব মানুষ আবদুল
ইম্পাল যাওয়ার পথে সব চেয়ে আজব লাগল চালক আবদুলের ব্যবহার। কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট করে সিগারেট জ্বালিয়ে জিপ সঙ্গে সিগারেটও টানছে নিজের ইচ্ছে মতো। হুট করে একটা বাজারে থামিয়ে জানাল ১২ হাজার রুপি না দিলে সে যাবে না। কি ব্যাপার প্রফেসর সিং কী জানালেন আর আবদুল কী করে। প্রফেসর সিংয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, আবদুল যা চায় দিয়ে দিতে পরে উনি বিষয়টি দেখছেন। কেননা এখান থেকে ফেরার আর পথ তো নেই। কিছুটা দর কাষাকষি করার পর গুনেগুনে ১১ হাজার রুপি ওকে দেওয়া হলে জিপ চলল। ঘণ্টাখানিক পর আবার হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে বলল, দুই/তিন মিনিট না ঘুমিয়ে সে চালাতে পারবে না। আজব ব্যাপার। এই হাজার মিটার উচ্চতায় পাহাড়ের উপরে ঘুমাতে হবে। তাও মনিপুরের পাহাড়ে। কে জানে কী বিপদ লুকিয়ে আছে। বোঝা গেল দুই/তিন মিনিট বুঝাতে ও দুই/তিন ঘন্টা বুঝিয়েছে। কি আর করা ওর কথার অবাধ্য তো হওয়া যাবে না। অচেনা অজানা পথে কী হয় কে জানে। সকালে চলতি পথে আচমকা গাড়ি থামিয়ে বলল, ‘তোমরা কেউ চা খাবে।’ আমরা বিরক্তি নিয়ে বললাম, না খাব না। ওর উত্তর, ‘তাহলে তোমরা থাক আমি খেয়ে আসি।’ আমাদের আবারও অবাক করল আবদুল। এই যেমন পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে জিপ থামিয়ে এক পলকে নেমে গ্লাস লাগিয়ে আমাদের ভিতরে রেখেই জিপ ধুতে থাকল।

হাত বাড়ালেই তারাকে ছুঁয়ে দেওয়া যাবে
আবদুলের এই কাণ্ড কারখানায় একটু বিরক্ত হলাম। রাতে ও জিপ থামাতেই আমরা নেমে পড়লাম। নেমে দেখি আমরা অনেক অনেক উপরে। কয়েক হাজার মিটার হবে। মধ্যরাতের আকাশটা যেন নিচে নেমে এসেছে। কয়েক হাত উপরে যেন তারাদের মেলা বসেছে। একটু লম্বা করে হাত বাড়ালেই তারাগুলোকে ছুঁয়ে দেওয়া যেত। আমার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম জিজ্ঞাসু নয়নে। জিপের আসনে ঘুমানোর জায়গা সবার হলো না। যে যেভাবে পেরেছে ঘুমিয়েছে। আমি রাস্তার এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলাম। এক শিক্ষক দূরে দোকানের বাইরে পাতা বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আর এক শিক্ষককে উঠিয়ে দিলাম জিপের বাইরের দিকে সামনে ইঞ্জিনের উপরে। সবাই অগভীর ও গভীর তন্দ্রাকে সাঙ্গ করল। শুধু আমি পাহারা দিচ্ছে সবার অজান্তে। হয়তো দরকার ছিল না। সাহসও ছিল না। শত হলেও মাওয়াবাদীদের এলাকা। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এমনটি দেখলে সবাইকে তো জাগিয়ে দিতে পারব আমি। তার ওপর দুই শিক্ষক বাইরে ঘুমিয়ে আছেন, একজন আবার একটু দূরে। পকটে হাত দিয়ে বুটের খট খট শব্দ নিয়ে এদিক ওদিকে হাটলাম। আমার মাথায় শিশিরের স্পর্শ অনুভব করেছি পরম আদরে। ৩টার দিকে আবদুলকে ডেকে তুললাম।

মেঘের উপরে আমরা
ভোরে জিপের ভিতরে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলম। এর মধ্যে আবদুল নাকি আরো একবার ঘুমিয়েছিল। উঠে দেখি জিপের চাকা হাটু সমান কাদা ভেঙ্গে যাচ্ছে। ‘শফিউল্লাহ, জিপ বন্ধ হয়ে গেলে ঠেলতে হবে কিন্ত।’ বললেন এক শিক্ষক। ভাগ্যিস এমনটা হয়নি। একটু পরে সকালের আলো ফুটতেই দেখলাম, মেঘের রাজত্বের বিস্তার। মেঘের দল বাঁধন ছিড়ে বেড়াচ্ছে ছন্নছাড়াভাবে। এই প্রথম জিপ থামাতে আমরা নির্দেশ দিলাম আবদুলকে। সবাই ক্যামেরা নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করলাম। ছবি তুললাম আশ মিটিয়ে। সকালের প্রথম মেঘের সান্নিধ্য পেলাম। সব ক্লান্তি ও বিরক্তি নিমেষেই উবে গেলে। সাদা মেঘের লাজুক হাসি অঙ্গে মাখলাম আমরা। এই প্রথম জানলাম মেঘের হাসি অঙ্গে মাখা যায়। আবদুল জানাল, এ তো কিছুই নয়  সামনে অনেক অনেক মেঘের দেখা মিলবে। সবাই অবাক, ‘বল কী!’ আরো মেঘের দেখা পাওয়া যাবে তাহলে। আসাম কি তাহলে মেঘের রাজ্য।