সুসং দুর্গাপুর

সাদামাটির দেশে

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : সাদাকা তামান্না

ঘোরাঘুরি নেশারই নামান্তর। কিছুদিন পরে পরে এই নেশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। বইমেলায় ঘুরছি আর কোথায় যাওয়া যায় তাই ভাবছি। মাথায় এলো এবার সাদামাটির পাহাড় দেখতে যাব, সুসং দুর্গাপুর, নেত্রকোনা। সবাই যাকে বলে বিরিশিরি। আসলে বিরিশিরিতে দেখার তেমন কিছু নেই, এটা একটা ইউনিয়ন মাত্র, আমরা সবাই ঘুরতে যাই দুর্গাপুরে।

যেভাবে যাবেন
যাই হোক, এবার পরিকল্পনা কীভাবে যাব, গাড়িতে নাকি ট্রেনে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো ট্রেনেই যাব। কিন্তু ট্রেনের টিকিট তো সোনার হরিণ। ফাস্ট ক্লাসের টিকিট না পেয়ে শোভন শ্রেণিতেই সই, ভাড়া ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জের ১৮৫ টাকা। শোভন শ্রেণিতে যাত্রা ভোগান্তিরই আরেক নাম। ২০ তারিখ রাতে ১১টা ৫০ মিনিটে আমাদের ট্রেন, হাওর এক্সপ্রেস। রাত ১০টা থেকেই একে একে হাজির হতে শুরু করে, নির্ধারিত সময়ের আগেই আমাদের টিমের সাত সদস্য উপস্থিত। একজন তো সন্ধ্যা ৬টা থেকেই হাজির!

স্টেশনে বাকি সময় হাসি ঠাট্টা করে পার করে দিলাম। ট্রেন যথাসময়েই ছাড়ল। ট্রেনে উঠেও হাসিঠাট্টা থামে না, খোশগল্প, একে অপরকে খোঁচাখুঁচি চলতেই থাকে। এভাবেই পেরিয়ে যায় ঘণ্টা দুইয়েকের মতো। প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল নেত্রকোনা নামব, সেখান থেকে কলমাকান্দা হয়ে দুর্গাপুর পৌঁছাব কিন্তু ট্রেনের মধ্যে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয় শ্যামগঞ্জ নেমে যাব, যা ছিল একটা মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। শ্যামগঞ্জ নেমে মহাবিপদ, এমনিতেই রাত তখন ৩টা, সাড়ে ৩টা। এখানে জারিয়া হয়ে দুর্গাপুর যেতে হয়। কিন্তু দুর্গাপুর যাওয়ার কোনো গাড়ি নেই, যে দুই একটা গাড়ি পাওয়া গেল তারা কেউই রাজি হয় না, রাস্তা নাকি মহাখারাপ। অবশেষে একটা মহেন্দ্রা পাওয়া গেল বটে কিন্তু চালক একদাম এক হাজার ২০০ টাকার নিচে যাবে না, শেষ পর্যন্ত এক হাজার ১০০ টাকায় রফা। অটোর যাত্রা শুরুর আগে হালকা চা, বিস্কুট খেয়ে নিলাম। যাত্রা শুরু রাতের আঁধারেই। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম কেন এদিকে কোনো ড্রাইভার আসতে চায় না। এটাকে রাস্তা বলে!? রাস্তা কই, যতই সামনে তাকাই দেখা যায় রীতিমতো ডোবা, নালা, গিরিখাদ, এখানে সেখানে গভীর গর্ত। মনে হলো ভয়ংকর ভাল্লুক থাবা মেরে খাবলাখাবলা মাংস তুলে নিয়েছে রাস্তার শরীর থেকে। রাস্তা এতটাই খারাপ যে আমাদের কথা দূরে থাক ড্রাইভার সাহেবেরই মেজাজ তিতিক্ষা হয়ে আছে, নিজেকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন কেন এলেন এদিকে, আমরা আর কি বলব! শরীর নাট বল্টুর পরীক্ষা দিতে দিতে এগিয়ে চলছে আমাদের অটো নামক পক্ষীরাজ। মাঝে কয়েকবার চালক বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামলেন, আমরা তখন চা-বিস্কুট খেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। অবশেষে চার ঘণ্টার এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের অটো এসে থামল বিরিশিরিতে, ড্রাইভার খুশি আমরাও খুশি।
যা দেখবেন
নেমে আড়মোড়া ভেঙে শরীর সতেজ করা ব্যায়াম চলল মিনিট খানেক। এবার ভাবছি কোন জায়গা থেকে শুরু করব, যেহেতু আমরা মাত্র একদিনের ট্যুরে এসেছি তাই যথাসম্ভব কম সময়ে বেশি স্পট দেখা যায় সেটাই মূল ভাবনার বিষয়। অটো থেমেছিল সোমেশ্বরী নদীর কাছেই। প্রতিজন ৫ টাকা দিয়ে নৌকা পার হয়ে রাস্তায় পাওয়া গেল একটা টং দোকান, পরোটা, চা পাওয়া যায়। সারা রাতের অভুক্ত আর রাস্তায় হাজারো ঝাঁকুনি খেয়ে একেকজন খিদেয় পাগল, যে যার মতো খাবারের ওপর হামলে পড়ল, হাড়ি-পাতিল পর্যন্ত চেটেপুটে খেয়ে শেষ। এবার শুরু আসল মিশন- টং দোকানে উদর পূর্তি করে ঘুরে বেড়ানোর পালা। দোকানের পাশে অপেক্ষমাণ একটা অটো ভাড়া করলাম ৬০০ টাকা দিয়ে, যতক্ষণ ঘুরব ততক্ষণই থাকবে। প্রথমেই হাজং মাতার স্মৃতি সৌধে, এখান থেকে সোজা বিডিআর ক্যাম্পের পাশেই গারো পাহাড় আর কমলা বাগান, যদিও এখন কমলা নেই। আদিবাসী পাড়ায় কথা বলে জানলাম এটাই এখানকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। পরের যাত্রা সোমেশ্বরী নদী। বিডিআর ক্যাম্পের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে এগোলেই সোমেশ্বরীর ক্রিস্টাল ক্লিয়ার পানি আপনাকে স্বাগত জানাবে। ৩০০ টাকা ঘণ্টা হিসেবে নৌকা ভাড়া নিয়ে নৌবিহার, এখানকার পানি এতটাই ক্লিয়ার যে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। চাইলে যে কেউ স্বচ্ছজলে গা ভিজিয়ে নিতে পারেন। ছোট্ট কিন্ত উপভোগ্য নৌবিহার শেষে এবারের গন্তব্য বিজয়পুরের সাদা মাটির পাহাড়ে, এখানেই বাংলাদেশের একমাত্র চীনামাটির পাহাড়। পাহাড়ের চূড়া থেকে একটা অসাধারণ ভিউ চোখের সামনে ধরা দিবে। সাথেই ছোট্ট একটা লেক, নীলাভ যার পানির রং, কেউ কেউ লেকের জলে নেমেও পড়ছে, যে যার মতো পারছে উপভোগ করছে প্রকৃতির এই অসাধারণ সৃষ্টি। পাশের রয়েছে স্বচ্ছ পানির আরেকটি পুকুর।
পাশে দু-কটি আম গাছ, চাইলে যার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারেন। তবে এই পুকুরে না নামাই ভালো, কর্তৃপক্ষ ‘বিপজ্জনক পুকুর’ বলে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। এই নিষেধ অমান্য করে কেউ কেউ পুকুরে নেমে পড়ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এভাবেই দুপুর পার, এদিকে সবার পেট ক্ষুধার অনুভব। পাশের বিরিশিরি বাজার থেকে সবাই মুরগি, মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। দেখার জন্য বাকি থাকল দুটো স্পট। প্রথমেই গেলাম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি। কিন্ত ভাগ্য খারাপ। ২১ ফেব্রুয়ারি তাই এটা আজ বন্ধ। কি আর করা চারপাশ ঘুরেই স্বাদ মিটাতে হলো এবং সর্বশেষ যাত্রা রাজবাড়ি দর্শন। রাজবাড়ি বলতে আমরা সাধারণত যা ভাবি ইয়া বিশাল বড় বাড়ি, ইট সুড়কি ঢালাই, এটা মোটেই তেমন নয়। এটাকে কাঠের ঘর বলা যায়, ঠিক রাজবাড়ি হিসেবে মন ভরে না। আর এভাবেই শেষের পথে আমাদের একদিনের ভ্রমণ।

যেভাবে ঢাকায় ফিরবেন
এবার ফেরার পালা। শুরুর মতো আবার সমস্যা, কোন দিক দিয়ে ফিরব।যাইহোক বিরিশিরি থেকে ঢাকার বাস সকাল ১০টায় ও রাত ১১টায়। যেহেতু আমাদের ওই দিনই চলে আসার প্লান তাই বিকেল ৫টায় দুর্গাপুর থেকে সিএনজি করে জনপ্রতি ২২০ টাকা করে ভাড়া সরাসরি ময়মনসিংহ চলে এলাম রাত সাড়ে ৮টায়।মাঝখানে একটি ছোটো ফেরিঘাট পার হতে হয়। এই রাস্তাটি পুরোটাই পিচঢালাই রাস্তা শুধু ফেরিঘাট টুকু পার হয়ে এক কিলোমিটারের মতো কাঁচা রাস্তা। তারপর রাত ৯টায় বাসে চড়লে ঘণ্টা তিনেক পর চোখ খুলেই চিরায়ত ঢাকা। যখনই সময় পাও ঘুরো, হোক একদিনের জন্য বা একাধিক দিনের।