বর্ষায় এই দিনে
চলুন যাই ৩৫০০ টাকায় ঝরনার গ্রামে
সবুজ বনানী আর ঘন অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের জনপথ দীঘিনালা। অরণ্যভূমি খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালার দূরত্ব প্রায় ২১ কিলোমিটার। ঝিরি,ঝরনা,পাহাড়,ছোট -বড় পাহাড়ি খালে ঘেরা সীমান্ত ঘেঁষা দীঘিনালা। সীমান্ত থেকে বয়ে আসা মাইনী নদীতে মিশেছে ঝরনার জল। বাইকে পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে বিনধোচুগ বিহারের চুড়ো থেকে মনে হয় দীঘিনালা যেন এক সবুজ উপত্যকা। প্রাগতৈহাসিক কালের সবুজে পাহাড়ে মোড়ানো দিগন্তের সীমারেখা। সবুজ সমতলজুড়ে সবুজের মখমল, পাহাড়ের চূড়া লেকে সবুজ ল্যান্ডকেসপজুড়ে পাহাড়ি সমতল ভূমি। ঘন অরণ্যঘেরা পাহাড়ের কোলজুড়ে বর্ষণের ধারায় নেমে আসে পাহাড়ি ঝরনা, অরণ্যে ঢেকে আছে চেনা-অচেনা ঝরনা।
বুনো ঝরনা তৈদুছড়া এক এবং তৈদুছড়া দুই, তোজেংমা, হরিণমারা, হাজাছড়া, শিবছড়ি এমনই কত ঝরনা ছড়িয়ে আছে দীঘিনালার ঘন অরণ্যে। এ যেন ঝরনার গ্রাম। বর্ষার সকালে সোনায় মোড়ানো ঝকঝকে আলোয় প্রাতঃরাশ করে রওনা হলাম ঝরনার পথে,কিছুটা পথ বাইকে চড়ে গেলাম, গাড়ি চলা পথ শেষ করে, পাহাড়ের পথ ধরে এগোতে থাকলাম। উঁচু -নিচু পাহাড়ি পথ পেরিয়ে সাক্ষাৎ পেলাম পাহাড়ি ঝিরি । বাকি পথটা ঝিরির পথ ধরে হাঁটলাম। ঝরনা থেকে বয়ে আসা ঝিরির পুরো পথটা সবুজ আবরণ ঢাকা, কোথাও কোমর পানি, কোথাও বুক পানির পাথুরে ঝিরির পথ মাড়িয়ে চলতে চলতে হঠাৎ দেখা পাওয়া জঙ্গলে ঢাকা পুরো ঝিরির পথ। ঝরনার কাছে যাওয়ার আগে প্রায় লাগোয়া দুটো পাথুরে পাহাড়। এ যেন আরব্য উপন্যাস আলীবাবার জাদুকরী দরজার মতো পাথুরে পাহাড় পেরিয়ে অবশেষে ঝরনা দর্শন। দুদিক থেকে আসা দুটো ঝরনার ধারা নেমেছে একই খুমে। এমন ঝরনা পাহাড়ে খুব একটা চোখে পড়ে না -পুরো ট্রেইল যেন ছবির মত। সবুজ পাহাড়ের বুক চিড়ে বের হয়ে যাওয়া বয়ে আসা ঝিরি পথে পথে বাসা বেঁধেছে হাজারো মাকড়সা। মাকড়সার জাল ছিড়ে সামনে অগ্রসর হতে হয়। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের মাঝখানে বয়ে যাওয়া ঝিরিই ঝরনার একমাত্র পথ,পাহাড়ে বয়ে যায় এসব ঝিরি যেন পাহাড়ের।বার্দ, ঝিরির শেষপ্রান্তে থাকে ঝরনার জলধারা।
তোজেংমা সবচেয়ে সুন্দর রূপ হলো দুটো ঝরনা একই সঙ্গে এসে পড়েছে। তোজেংমা যেতে পথে পথে দেখবেন নীতিদীর্ঘ পাহাড়ের ঢেউ।বর্ষার রৌদ্রময় আকাশে নীল রঙের ছড়াছড়ি, রৌদ্রের খরতাপ মাথার নিয়ে পাহাড়ি আদিবাসীরা বুনুন করছে জুমের ক্ষেতে, এই শুধু সাধারণ জুম চাষ নয়। সার বছরে স্বপ্ন বুনুন হয় পাহাড়ে খাঁজে খাঁজে। দুর্গম পাহাড়ে আদিবাসীদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায় জুম চাষ। জুমক্ষেতের পাশ দিয়ে আপনাকে যেতে হবে ঝিরি পর্যন্ত। ঝিরিপথ মানেই তো ট্রেকিংয়ের কষ্ট অর্ধেক কমে যাওয়া। তোজেংমা ঝরনায় যেতে আপনাকে বাকি পথটুকু এই ঝিরি পথে হেঁটে যেতে হবে। বন্য পরিবেশের ঝিরির পানি কেটে কেটে সামনে অগ্রসর হতে হবে। বড়-ছোট পাথরে ভরা ঝিরির পথ। কোথাও কোথাও ঘন সবুজ আচ্ছাদন। বড় বড় লতা নেমেছে গাছের ওপর থেকে, মূল ঝিরি থেকে আলাদা বাঁক নিয়ে তোজেংমার মূল ট্রেইল ধরে পথ চলতে হয়। ঝিরি, পাথর, পানির স্রোত এসব পেরিয়ে বৃহৎ দরজা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটো পাহাড়। মনে হচ্ছে ঝরনার স্রোত বোধহয় এই দুটো পাথুরে পাহাড়ের মধ্যভাগজুড়ে জলের স্রোত বয়ে নিয়ে গেছে। পাথুরে পাহাড় ছাড়িয়ে সামনে যেতেই দৃষ্টি আবদ্ধ হয় ঝরনায়। পাহাড় বেয়ে নিরন্তর পানির স্রোত নামছে পাথুরে ঝরনায়। বুনো পথে পাহাড়ি ঝরনা তোজেংমা।
তোজেংমার পর্ব শেষ করে ঘুরে আসতে পারেন তৈদুছড়া দীঘিনালার দুর্গম সীমানা পেরিয়ে সন্ধান পাবেন এই বুনো ঝরনা। ক্যাসকেডের সরু পথ পেরিয়ে তৈদুছড়া। দুই পাহাড়ের মাঝে আড়াআড়িভাবে যুক্ত দুটি মরা গাছের কাণ্ড। নিচে গভীর জলপ্রপাত। নামতে হবে বৃষ্টি ভেজা মরা গাছের এই কাণ্ড বেয়ে। নিচে নামার পর পাওয়া গেল পা দেওয়ার মতো ছোট্ট একটা পাথর। পা ফসকে গেলেই গভীর খাদে হারিয়ে যেতে হবে। এমনই ট্রেইল ধরে যেতে হয় তৈদুছড়া ঝরনায়।
আকাশে কালো মেঘ, বৃষ্টি, ঝিরির পথে গলা-কোমর সমান পানি, পাথুরে পথ এসবে ঠাঁসা। ভরা বর্ষায় ঝরনার রূপ দেখতেই এই যাত্রা। সকালের বৃষ্টি মাথায় যাত্রা শুরু। প্রথমেই কোমর সমান ঝিরির পথ। খরস্রোতা বোয়ালখালি খালের পথ ধরে সামনে এগোতে হবে অনেকখানি। ঝিরিতে খুব জোরে হাঁটার সুযোগ নেই, ধীরে ধীরে পা চালিয়ে এগোতে হয়।
হঠাৎ চোখে পড়ে বড় বড় পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা সাদা মেঘের দলছুট স্তূপ, সবুজ পাহাড়কে মুড়িয়ে রেখেছে চেনা মেঘের দল, পাহাড়ের কোলজুড়ে বড় বড় জুমের ক্ষেত। সবুজ বনের মাঝখানে ছোট্ট জুমের ঘর। নিজেদের বাগানের সুরক্ষার জন্য পাহাড়ি জুম চাষিরা এই ছোট্ট জুম তৈরি করে।
ঝিরির পথ শেষে দেখা মিলল উঁচু পাহাড়ি পথ। এখন সবুজ পাহাড়ে ছোট্ট ট্রেইল বেয়ে উঠতে হবে। একটানা বৃষ্টিতে উপরে ওঠার পুরো পথটাই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। বৃষ্টিমাখা পথ বেয়ে দীর্ঘসময় নিয়ে ওঠার পর পাওয়া গেল পাহাড়ের শীর্ষদেশ। এক নজরের পুরোটা আকাশ দেখে নেওয়া যায়। উঁচু পাহাড় থেকে নিচের ঝিরি পথ, ট্রেইল, জুমের ক্ষেত আর সবুজ বনকে বেশ লাগে।
আমাদের গাইড জানাল এবার নামতে হবে। কিন্তু পথ কই? বর্ষায় এই অচেনা পথে কেউ না হাঁটায় পুরো পথটা জঙ্গলে ভরপুর। তাই পথ বদল করে অন্য পথ ধরা হলো। অচেনার পথ বেয়ে নামতে নামতে ঝরনার পানি আছড়ে পড়ার শব্দ কানে আসছিল।
পাহাড়ি পথ ছেড়ে আবার নামলাম ঝিরির পথে। বড় বড় পাথর ঝিরিজুড়ে। এক পাথর থেকে অন্য পাথরে পা মাড়িয়ে এগোতে হয়। পথের শেষে ঝরনার স্রোত! সবুজ পাহাড় থেকে সাদা রেখার মতো নেমে আসছে।
পাহাড়ের পাথর বেয়ে নেমে আসছিল জলের ধারা। নিচে আসতে আসতে ক্রমশ বড় হয়েছে। পাথরের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে সাদা ফেনা মাথায় করে। সবুজ বনের মধ্যে তৈদুছড়ার এমন জলের স্রোত কেবল বর্ষাতেই দেখা যায়।
তোজেংমা, তৈদুছড়া ছাড়াও হাজাছড়া, হরিণমারা দেখতে হলে দীঘিনালা হয়ে যাওয়াটাই ভালো, হরিণমারা, হাজাছড়ার অবস্থান বাঘাইহাট হলেও যাওয়ার সহজ পথ দীঘিনালা হয়ে। এই বর্ষায় বেড়িয়ে আসুন পাহাড়ের এই জনপথে।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি সরাসরি বাসে যাতায়াত করা যায়।ঢাকার কলাবাগান এবং গাবতলী থেকে শ্যামলী, শান্তি, সৌদিয়া, এস আলমসহ, রিফাত, ইকোনো, সেন্টমার্টিন বিভিন্ন পরিবহন প্রতিদিন যাতায়াত করে। তবে মহাখালী থেকে রিফাত পরিবহন ছেড়ে যায়। খাগড়াছড়ি থেকে সিএনজি বা বাইকে দীঘিনালা পৌঁছানো যায়। তা ছাড়া খাগড়াছড়িতে রাতযাপনের জন্য- হোটেল গাইরিং, ইকোছড়িসহ বেশকিছু ভালো মানের হোটেল আছে।
খরচাপাতি
আপনি যদি ঢাকা থেকে যান তাহলে আপনার জন্য সাশ্রয়ী হবে। ধরুন দুই রাত তিনদিনের জন্য যদি যেতে চান তাহলে আপনার খরচ হবে প্রত্যেকদিন থাকা- খাওয়াসহ এক হাজার টাকা। আর আপনি ঢাকা থেকে যেকোনো পরিবহনে যেতে চাইলে এসি বাসে খরচ ৯০০ টাকা , নন-এসি ৫২০ থেকে ৬০০ টাকা।
আর খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা সিএনজি বা বাইকে যেতে চাইলে আপনার খরচ পড়বে জনপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা।
অতএব দুই রাত তিনদিনের জন্য সর্বমোট খরচ হবে আপনার প্রায় তিন হাজার ৫০০ টাকা।
প্রয়োজনীয় তথ্য
ঝরনায় বেড়াতে গেলে তার আশপাশটা পরিষ্কার রাখবেন। বিশেষ করে প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল, খাবার প্যাকেট- এসব ফেলে আসবেন না। আদিবাসীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করা থেকে বিরত থাকবেন। খাগড়াছড়ির ঝরনাগুলো ভ্রমণের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮১৫-৮৫৬৪৯৭, ০১৫৫৬-৭১০০৪৩ নম্বরে।