ছুটির দিনে

'যেখানে সাঁইর বারামখানা'

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত কুষ্টিয়া। ব্রিটিশ ঐতিহ্য এখনো আঁকড়ে রেখেছে এই শহর। শহরের মিলপাড়া এলাকাতে ঢুকলে আপনারও এই মতিভ্রম হতে পারে। এই মিলপাড়ার শেষ মাথাতেই ঘুমিয়ে আছেন লালন সাঁই। কুষ্টিয়া শহরের কয়েক শত বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান লালন সাঁই। এই শহর লালনের স্বপ্নের সেই আরশিনগর। তো চলুন লালন সাঁই সম্পর্কে জেনে নিই :

লালন শাহ্‌ চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ছেউড়িয়া, কুমারখালি উপজেলাতে । কুমারখালি উপজেলাতে ছেউড়িয়ার ভেতরে পড়লেও কুষ্টিয়ার প্রাণকেন্দ্র মজমপুর গেট থেকে আখড়া বাড়ির দুরত্ত্ব একেবারেই কম । কুষ্টিয়ার প্রাণকেন্দ্র মজমপুর গেট থেকে আখড়া বাড়ির দুরত্ব ১.৫ কি.মি.। আর কুমারখালি থেকে আখড়া বাড়ির দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার।   

সাঁইজির আখড়া বাংলাদেশের সব বাউল সাধকের পীঠভূমি। বর্তমানে প্রায় ২৭ বিঘা জায়গার ওপর লালন সাঁইজির বিখ্যাত আখড়া বাড়ি অবস্থিত। সাঁইজিসহ মুল আখড়াটি যেখানে ছিল, সেখানে এখন আছে কংক্রিটের মাজার ঘর, সেই ঘরের ছাদের নিচেই শুয়ে আছেন বাউল সংগীতের প্রাণ পুরুষ লালন সাঁইজি ।

যা দেখবেন

সাঁইজির কবরের পাশেই তাঁর পালক মা মতিজান ফকিরানীর কবর। মায়ের কোলে পরম মমতাতে শুয়ে আছেন লালন সাঁই। আঙিনাতে শুয়ে আছেন পালক পিতা মওলানা মলম শাহ, ফকির আফিজ উদ্দিন শাহ্‌, গুরু মহিম শাহ্‌, শান্তি ফকিরনি, কুসুম ফকিরনী, ফকির গোলাম ইয়াছিন শাহ্‌, ভোলাই শাহ ফকিরসহ লালন সাঁইজির মোট ৩২ জন সাথী।

এখানে আছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত লালন একাডেমি এবং লালন জাদুঘর। লালন একাডেমির নিচতলা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, সেখানে ফকির সাহেবদের জায়গা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। চাইলে যে কেউ বিনা খরচে সেখানে রাত কাঁটাতে পারবেন।

আরো যা দেখবেন

সাঁইজির আখড়া থেকে বের হয়ে কয়েক পা গেলেই চোখে পড়বে চোখ ধাঁধানো কুটির শিল্প সমেত গোটা পঁচিশেক দোকান। আখড়ার মার্কেট। সাধ্যের ভিতরেই এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন আপনার পছন্দের শোপিসগুলো। এখান থেকে কাঠের এবং মাটির তৈরি বিভিন্ন কুটির শিল্প সামগ্রী সারা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এই মার্কেটগুলোতে পাবেন কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি, গামছা ও বেডশিট। বাউল সংগীতের বিভিন্ন সরঞ্জামসহ লালন সংগীতের সিডি ও ক্যাসেটও চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন এখান থেকে।

সেখান থেকে আরেকটু সামনে এগুলেই দেখতে পারবেন কালিগঙ্গা নদী, লালনমঞ্চ এবং এবং বিশাল মাঠ, এই মাঠেই লালন মেলা  হয়ে থাকে । নদীর তীর ঘেঁষে বসার জায়গা আছে, চাইলে লালন সংগীত শুনতে শুনতে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারেন সেখানে।

লালন জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য

শুধু লালন জাদুঘরে ঢুকতে হলে ৫ টাকা খরচ করতে হবে। বিদেশিদের জন্য ২০ টাকা। মিউজিয়ামে লালন সাঁইয়ের এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং হাতে আঁকা বেশ কিছু শিল্পকর্ম রয়েছে। জাদুঘরটি জাদুঘর হিসেবে খুব একটি উন্নত নয়।

লালন সাঁইয়ের আখড়া বাড়ি এবং আঙিনায় বাগানসহ আশপাশের অন্যান্য জায়গাতে ঘুরতে কোনো টাকা ব্যয় করতে হয় না।

লালন আখড়ায় লালনের গান

সাধক বাউলদের কিছু নামে মাত্র সন্মানি দিলেই তারা সারাদিন লালনের গান শোনাবে। এমনিতেও কোনো না কোনো সাধক আখড়ার ভিতরে গান গাচ্ছেই। লালন একাডেমির নিচতলাতে বসে কিছু সময়ের জন্য আপনি হারিয়ে যেতে পারেন লালনের যুগে, গান শুনতে শুনতে। হয়তো আপনার মাঝেই দেখা দেবে আপনার ভিতরে বাস করা আপনার আপন মনের মানুষ।

সাঁইজির আখড়াতে কখন আসবেন

লালান সাঁইজির আখড়াতে আসতে পারেন বছরের যেকোনো সময়ই। তবে বছরে দুবার কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন এবং লালন একাডেমির আয়োজনে হয় ভান্ডারা কিংবা লালনে স্মরণে মহাউৎসব। এই মহাউৎসব সাধারণত তিন-পাঁচ দিনব্যাপী হয়ে থাকে। একটি মহাউৎসব শুরু হয় দোল পূর্ণিমার (চাঁদের ওপর নির্ভরশীল) দিন থেকে, এবং অপরটি সাঁইজির মৃত্যবার্ষিকী পহেলা কার্তিক (১৭ই অক্টোবর)।

হাতে সময় থাকলে দেরি করবেন না। চলে আসুন লালন সাঁইজির আরশি নগরে।

কেন আসবেন সাঁইজির আখড়াতে

লালান সাঁইজির আখড়া দেখার জন্য আপনি এখানে আসবেন না। লালান সাইজির আখড়া যতটা ভ্রমণের জায়গা তার থেকে বেশি অনুভূতির জায়গা, বোঝার জায়গা। নিঃসন্দেহে লালান সাঁই ছিলেন এই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। লালনের দর্শন অনুভবের জন্য, নিজেকে চেনার জন্য এমন ভালো এবং সাংস্কৃতি পরিবেষ্টিত জায়গা লালান সাঁইজির আখড়া ছাড়া আর কোথাও মনে হয় না আছে বাংলাদেশে। সব থেকে রসকষ হীন ব্যক্তিটিও সাঁইজির আখড়াতে এলে গান না গেয়ে থাকতে পারবেন না। এই জায়গাটি শুধু বাউল ফকিরদের ফেলে রাখা একটি আখড়া বাড়ি নয়, এই জায়গাটি আসলে একটি আয়না।

কীভাবে আসবেন

ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া আশা এখন বেশ সহজ। বাস, ট্রেন ও বিমান তিনভাবে আশা যায় । বাসে আসাটাই সব থেকে সহজ। এসবি, হানিফ, শ্যামলি, আর কে, জে আর, কুষ্টিয়া এক্সপ্রেস, মামুনসহ বেশ কিছু বাস আছে ঢাকা-কুষ্টিয়া রুটে। এদের ভিতর সব থেকে ভালো সার্ভিস এসবি পরিবহন দিয়ে থাকে। একমাত্র এসবি পরিবহনের এসি গাড়ি আছে। লাক্সারি এসিতে ১০০০ টাকা এবং সাধারণ এসিগুলোতে ৬০০ টাকা ভাড়া পড়বে একজনের জন্য। এসবির এসি গাড়ির টিকেটের জন্য আপনাকে দুই থেকে তিনদিন আগেই টিকেট সংগ্রহ করতে হবে। কারণ এসি গাড়িতে টিকেটের চাপ অনেক বেশি। সব কোম্পানির বাসে সাধারণ চেয়ারগুলোতে ভাড়া পড়বে ৪৫০ টাকা করে। বাসে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া সময় লাগবে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা।

ঢাকা থেকে প্রতিদিন দুটি ট্রেন ছেড়ে আসে কুষ্টিয়ার উদ্দেশে।একটি চিত্রা অপরটি সুন্দরবন। চিত্রা ঢাকা থেকে ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টায় এবং সুন্দরবন এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে ছাড়ে সকাল ৬টা ২০ মিনিটে। কুষ্টিয়াতে সরাসরি ট্রেন নেই। ট্রেনে কুষ্টিয়া আসতে গেলে আপনাকে পোড়াদহ নামতে হবে। পোড়াদহ থেকে কুষ্টিয়া আসতে অটো এবং সিএনজিতে ২০ টাকা করে খরচ হবে। ট্রেনে সময় লাগবে প্রায় ৭ ঘণ্টা। চিত্রা পোড়াদহ থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় দুপুর ১২টায়। এবং সুন্দরবন এক্সপ্রেস ছেঁড়ে যায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটে। ট্রেনের ভাড়া শোভন ক্লাসে ২৫০ টাকা থেকে এসি বাথে ১৪০০ টাকার ভিতরে।

সরাসরি বিমানরুট নেই কুষ্টিয়া ঢাকার। যশোর হয়ে আসতে হবে। ঢাকা-যশোর রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের ভাড়া পড়বে তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার ৫০০ টাকা। ইউএস বাংলা এয়ার লাইন্সে খরচ পরবে ৩৮০০ থেকে ৭০০০ টাকা। নভো এয়ারে খরচ পড়বে ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা। ইউনাইডেট এয়ার ওয়েজ এ খরচ পড়বে তিন হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা। রিজেন্ট এয়ার ওয়েজে খরচ শুরু তিন হাজার ২০০ টাকা। যশোর থেকে কুষ্টিয়া বাসে আসতে সময় লাগবে দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিট, খরচ পড়বে ১০০-১৫০ টাকা। বিমানে ঢাকা থেকে যশোর সময় লাগবে আধাঘণ্টা।

কোথায় থাকবেন

কুষ্টিয়া শহরে থাকার জন্য অলিগলিতে বেশ কিছু ভালো ও মাঝারি মানের হোটেল পাওয়া যাবে। এর মধ্যে বিশ্বাস হোটেল, হোটেল প্রীতম, হোটেল রিভারভিউ, হোটেল শাপলা, হোটেল সানমুন, হোটেল রাতুল, হোটেল নুর ইন্টারন্যাশনাল, দিশা টার্ফ, প্রবাসী হোটেল, সফিউল হোটেল, হোটেল গ্রিনল্যান্ড, হোটেল শিল্টন, হোটেল এশীয়া, আজমেরি হোটেল বেশ প্রসিদ্ধ। এখানে এসি, নন-এসি সিঙ্গেল ও ডাবল সব ধরনের রুমই পাবেন। এসি সিঙ্গেলের জন্য খরচ হবে ৭০০-১০০০ টাকা এবং এসি ডাবলের খরচ পড়বে ১২০০-২০০০ টাকা। নন এসি সিঙ্গেল এবং ডাবল রুম পড়বে ৩০০-৫৫০ টাকা। হোটেলগুলোর নির্দিষ্ট ভাড়ার চার্ট নেই। আপনার কথা বলে ভাড়া মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকছে। বেশির ভাগ হোটেলের অনলাইন বুকিং নেই। এখানে এসে বুকিং দিতে হবে।লালন উৎসবের সময় সব হোটেলেই ভাড়া কিন্তু দিগুণ হয়ে যায়।

কোথায় খাবেন

কুষ্টিয়াতে খাবারে খুব একটা বৈচিত্র্য পাবেন না। একদম সাদামাটা খাবার। তবে জায়গা অনুপাতে খাবারের দাম কম-বেশি হতে পারে। কুষ্টিয়ার জাহাঙ্গীর হোটেল, শিল্পী হোটেল, শফি হোটেল, হোটেল খাওয়া-দাওয়া বেশ বিখ্যাত। চাইনিজ কিংবা বিদেশি খাবার খেতে চাইলে চিলিস, টমাটিনো, মৌবন, নবান্ন ও খেয়া বিখ্যাত। খেয়ার খাবারের দাম অন্যদের তুলনায় বেশি। তবে লালন সাঁইজির আখড়ার পাশে নিশুতি হোটেল বেশ জনপ্রিয়।