কাশ্মীরের পেহেলগামে একদিন

Looks like you've blocked notifications!
পেহেলগামে ‘কাশ্মীর ও দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন’-এর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

গ্রীষ্মকালের কাশ্মীর ভ্রমণে পেহেলগাম এক কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। কাশ্মীর উপত্যকার সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র এটি। স্থানীয় ভাষায় পেহেলগাম শব্দের অর্থ ভেড়াওয়ালাদের গ্রাম। ভেড়া ও বকরি চরানো ছিল এখানকার মূল বাসিন্দাদের আদি পেশা। পাহাড়ি এই দরিদ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘গুজার’ও বলা হয়। তারা বিভিন্ন মালিকের কাছ থেকে ভেড়া ও বকরি চরানোর জন্য নেয়। গ্রীষ্মকালজুড়ে সেগুলোকে পাহাড়ে-উপত্যকায় চরিয়ে বেড়ায়। শীতের শুরুতে আবার ফেরত দেয় মালিকের কাছে। পিছিয়ে পড়া এই মানুষগুলোর সঙ্গে এখনো দেখা মেলে পেহেলগামসহ কাশ্মীরের সব পাহাড়ি এলাকায়।

শ্রীনগর থেকে ৯৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত পেহেলগাম। এখন আর এটি গুজারদের জন্য বিখ্যাত নয়। এটি মূলত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য নির্মল প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে সময় কাটানোর একটা দারুণ গন্তব্য। অগণিত প্রকৃতিপ্রেমিক এই নৈস্বর্গিক সুন্দরের কাছে গিয়ে দিনের পর দিন অবস্থান করেন। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে তীব্র তুষারপাত হয়। তখন পর্যটকের সংখ্যা কমে আসে। এটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় রূপ নেয় এপ্রিল-মে মাসে। হিমালয়ের মাঝারি (পিরপাঞ্জাল) পর্বতমালার একটি ভ্যালির নাম লিডর ভ্যালি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত, সবুজ পাহাড় আর অগণিত পাথর বিছানো আঁকাবাঁকা ওই ভ্যালির বুক চিরে বয়ে চলা লিড্র নদীর হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য পর্যটকের মূল আকর্ষণ।

কয়েকদিন আগে পেহেলগাম ঘুরে এলাম ‘কাশ্মীর ও সাউথ এশিয়া স্টাডিজ’র শিক্ষার্থী হিসেবে। নেপাল, আফগানিস্তান, বাংলাদেশি সার্ক-শিক্ষার্থী ও কাশ্মীরি সহপাঠীদের পাশাপাশি আমাদের সঙ্গে ছিলেন পাঁচজন শিক্ষক। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে সূর্যোদয়ের পরপরই যাত্রা শুরু করে বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম অনন্তনাগ জেলায়। বাসের মধ্যে নানা ভাষায় হৈ চৈ, আউল-বাউল গান আর সুরতালে মগ্ন ছিলাম সবাই। কাশ্মীরি ভাষার ফোক গান ‘ওয়ানয়ূন’ আর বাংলা, নেপালি, আফগানি লোকগান মিলে-মিশে একাকার হয়ে পড়েছিল যেন। মূল শহরের বাইরে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে চলছিল গাড়ি।

একটি পাহাড় পেরিয়ে লিডর ভ্যালিতে প্রবেশ করতেই বাসের মধ্যে আমাদের হৈ চৈ মিইয়ে গেল। পাহাড়ি ঝরনার কলকল রব তুলে নিরন্তর বয়ে চলা আর নির্মল প্রকৃতির অপূর্ব শোভা সবার দৃষ্টি কেড়ে নিল বাইরে। বাসের জানালা দিয়ে এপাশে তাকাই, দেখি বিশাল পর্বতের গা জুড়ে আকাশছোঁয়া সবুজ, অন্য পাশে গভীর উপত্যকার বুক চিরে রিমঝিম শব্দে বয়ে চলছে একমুখী নদী। হিমালয়ের গা বেয়ে নেমে আসা বরফ-ঠান্ডা পানি পাথরের ছোঁয়া লেগে ঘূর্ণি তুলে এগোয়। সেখানে জেগে ওঠে সাদা ফেনা। স্বচ্ছ পানির বুকে ঢেউ খায় আকাশের নীল। মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয় মানুষের হৃদয়-মন। সেখান থেকে মূল পেহেলগাম আরো ছয় কিলোমিটার। পুরো রাস্তাজুড়ে একই রকম দৃশ্য। যতই সামনে যাই, শুনি আরো বাকি আছে দেখার। পর্যটন স্পটে পৌঁছে বাস থেকে নামলাম। সেখানে সাজানো আছে নানা হোটেল, রেস্তোরাঁ, পার্কসহ নানা ব্যবস্থা। দুপুরের খাওয়া সেরে সবাই নেমে গেলাম জলের ধারে। ফটোসেশন হলো। তারপর নদীর পাড় ঘেঁষে হেঁটে বেড়ালাম খানিক দূর। ছোট্ট-শিশুরা হৈ চৈ করছে সেখানে। স্কুলের শিশুরা এসেছে বনভোজনে। নিচে বহতা নদী, পাশে পর্বতের দেয়ালজুড়ে সবুজ গাছ, দূরে তুষারের মুকুট পরা শৃঙ্গ, আরো দূরে নীল আকাশ।

অনিন্দ্য সুন্দরের এই সজ্জা দেখে আমি ছিলাম অনেকটা নির্বাক। আমার এক কাশ্মীরি বন্ধু এসে জানতে চাইল, কেমন লাগছে পেহেলগাম? ওর দিকে তাকালাম। বললাম, সুন্দর! মনোহর!! মনে হলো, গর্বে ওর বুক ফুলে উঠেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কাশ্মীর হামারা হ্যায়।’ একদিন বন্ধুদের সামনে গাইছিলাম, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। ইংরেজি তরজমা করে বুঝিয়ে দিলাম কাশ্মীরি সহপাঠীকে। বলল, ‘মাতৃভূমির প্রতি সবার দাবি এমনই। আমার কাছেও কাশ্মীর তাই।’

পেহেলগাম থেকে অনেকেই ঘোড়ায় চড়ে যান কোলাহাই গ্লেসিয়ারের (পর্বতের গায়ে বরফের আস্তরণ) কাছে। হিমালয়ান ওয়ান্ডারস ব্লগে ডেভিড ইউরম্যান লিখেছেন গত বছর তাঁর সস্ত্রীক ভ্রমণের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘বিশালাকার সব দেবদারু গাছ, বন্য ফুলে ভরপুর তৃণভূমি, তীব্র বেগে ধাবমান নীলাভ নদী, তুষারঢাকা শৃঙ্গরাজি রীতিমতো বিহ্বল করে দেওয়ার মতো।’ ৫৪২৫ মিটার উঁচু কোলাহাই গ্লেসিয়ার থেকে বরফ গলে সৃষ্টি হওয়া পানি লিডর ভ্যালির মাঝদিয়ে বয়ে গেছে। ২৬ কিলোমিটার নেমে এসে পেহেলগাম অতিক্রম করেছে। পরে সেটা মিলিত হয়েছে ঝিলম নদীতে। পর্যটনকেন্দ্র ছাড়াও ওই জায়গাটি বিখ্যাত অমরনাথ গুহার তীর্থযাত্রীদের একটি অন্যতম বেইস ক্যাম্প।

অমরনাথ হলো হিমালয় পর্বতের একটি বরফগুহা, যেখানে ‘শিবলিঙ্গের’ মতো একটি দণ্ড প্রতিবছর দৃষ্টিগোচর হয়। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি তীর্থস্থান। অনুসারীদের বিশ্বাস, লর্ড শিব তার সঙ্গিনী পার্বতীর কাছে ওই গুহাতে বসেই জীবন ও জগতের রহস্য উদঘাটিত করেছিলেন। প্রতিবছর জুলাই ও আগস্ট মাসে লক্ষাধিক তীর্থযাত্রী অমরনাথের উদ্দেশে যাত্রা করে। তাদের অনেকেই লিডর ভ্যালির ওপর দিয়ে পেহেলগাম হয়ে পর্বতারোহণ করে। তীর্থযাত্রার কারণে জুলাই-আগস্ট মাসে পর্যটকসংখ্যা কমে আসে পেহেলগামে। পুরো এলাকাজুড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা হয়ে ওঠে কঠোরতম নিশ্ছিদ্র।