ঈদে ঘোরাঘুরি

বৃক্ষের রাজ্য ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক

Looks like you've blocked notifications!

বৃক্ষের সাথে মানবজাতির সম্পর্ক চিরদিনের। সে জন্যই কর্মজীবনের ক্লান্তি দূরীভূত করার জন্য একটু অবকাশ পেলেই মানুষ ছুটে যায় বৃক্ষের কাছে। যন্ত্রের শহরে আমরাও হয়ে উঠি সভ্যতার কলকব্জা, দিনে দিনে হারাতে থাকে মনের সৌন্দর্য, অনুভূতির দরজা। এভাবে একটা সময় এ শহরের প্রতি বিরক্তও এসে যায় আমাদের। বিশ্বকবিও এই ধূলিমাখা শহরকে দূরে ঠেলে চেয়েছেন একটু সবুজ, একটু সুন্দর। তাই তিনি বলেছিলেন " লও হে নগর, ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য।" কারন অরণ্য কখনো কার্পণ্য করে না, আমাদের শান্তি দেয় দুই হাত ভরে এবং শুধু শান্তিই দেয়। এক কথায় বন হচ্ছে শান্তির রাজ্য, যেখানে রাজত্ব করে পাখপাখালি, মুক্ত উড়ে বেড়ায়, গান গায়। সে রাজত্বের গর্বিত প্রজা হতে পারেন আপনিও, উড়তে পারেন পাখির মতো, হাসতে পারেন, গাইতে পারেন, আর ভুলতে পারেন ক্লান্তি।

 

এমনই একটি শান্তির রাজ্য ভাওয়ালের বনভূমি। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার উত্তরে গাজীপুর জেলার গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর উপজেলায় এই অপরূপ বৃক্ষরাজ্যের অবস্থান। লাল মাটির উর্বর ভূমিতে সেই সহস্র বছর আগেই এখানে জমে উঠেছিল বৃক্ষের আখড়া, হয়তো তখনো উদিত হয়নি ধূলিমাখা শহরের সভ্যতার সূর্য। ভাওয়ালের বনভূমির প্রধান বৃক্ষ গজারি, এ কারণে একে ভাওয়ালের গজারির গড়ও বলা হয়। দেশে যে কয়টি বৃহৎ প্রাকৃতিক বনভূমি রয়েছে তার মধ্যে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় অন্যতম। ঐতিহ্য, সৌন্দর্যে ভাওয়াল গড়ের তুলনা হয় না। আকর্ষণীয় সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্রের কারণে ক্রমেই ভাওয়ালের গড় পরিণত হতে থাকে পর্যটকদের পছন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই পর্যটকদের আগ্রহ আরো বাড়াতে এবং এর জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু প্রথম ভাওয়ালের গড়কে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। উদ্যান ঘোষণার পর থেকে এর প্রতি সরকারের নজর অনেক বেড়ে যায়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-(১৯৭৪) অনুযায়ী পাঁচ হাজার ২২ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই উদ্যান গড়ে তোলা হয়। এখানে পর্যটকদের জন্য বৃদ্ধি করা হয় যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা। এক কথায় বনকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় মনোরম পিকনিক স্পট, তথা একটি অত্যাধুনিক রিসোর্ট। এর ফলে সুযোগ হয়েছে বনের ভেতর ঘুরে বন্যপ্রাণী দেখার এবং বনের ভেতর রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা অর্জনের।

 

যা দেখবেন

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান মূলত ক্রান্তীয় পতনশীল পত্রযুক্ত বৃক্ষের বনভূমি। এ বনে শালগাছের আধিক্য রয়েছে। গজারি বনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শীতকালে এই বৃক্ষের পাতা ঝরে যায়, গ্রীষ্মকালে আবার নতুন পাতা গজায়। সেই হিসেবে বর্ষার এই সময়ে পুরো বন এখন ঘন সবুজ। প্রাণীবৈচিত্র্যের দিক দিয়ে এই উদ্যান অনন্য। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে একসময় বাঘ, কালো চিতা, চিতাবাঘ, মেঘাবাঘ, হাতি, ময়ূর, মায়া হরিণ ও সম্বর হরিণ দেখা যেত। সময়ের পরিক্রমায় সেসব এখন আর তেমনটা নেই। তবে খেকশিয়াল, বাগদাস, বেজি, কাঠবিড়ালী, গুঁইসাপ আর কয়েক প্রজাতির সাপের দেখা মেলে এখনো। এ উদ্যানে গড়ে প্রায় ৬৪ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী, নয় প্রজাতির সরীসৃপ, ১০ প্রজাতির উভচর ও ৩৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বন বিভাগ এই বনে অজগর, ময়ূর, হরিণ ও মেছোবাঘ ছেড়েছে। বনে হাঁটার সময় দেখা মেলবে স্ট্রুর্ক বিলড কিংফিশার বা মেঘ হু, মাছরাঙ্গা, খয়রা গেছো পেঁচা, কাঠ ময়ূর, বন মোরগ, মুরগি। দেখা মিলবে বানর ও মুখপোড়া হনুমানেরও। এত সব প্রাণী একসাথে দেখে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ইচ্ছে জাগবে ‘ইশ! যদি ঘর বাঁধতে পারতাম এই পাখিদের সাথে, এই ঘন সবুজের মাঝে, তাহলে হয়তোবা জীবনটা সত্যিকারের স্বার্থক হতো।’

উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের দিক দিয়েও এ বন বিশেষভাবে আলোচিত। । এ বনে ২২১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে যার মধ্যে ২৪ প্রজাতির লতা, ২৭ প্রজাতির তৃণ, তিন প্রজাতির পাম জাতীয় বৃক্ষ, ১০৫ প্রজাতির ঔষধি, ১৯ প্রজাতির গুল্ম, ৪৩ প্রজাতির বৃক্ষ। শাল এ উদ্যানের প্রধান বৃক্ষ। নানা গাছপালায় সমৃদ্ধ জাতীয় এ উদ্যান। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শাল, বহেড়া, আমলকি, হলুদ, আমড়া, জিগা, ভাদি, অশ্বত্থ, বট,

সর্পগন্ধা, শতমূলী, জায়না, বিধা, হারগোজা, বেহুলা ইত্যাদি। এ ছাড়া নানান প্রজাতির লতাগুল্ম আছে এ বনে। অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে কাঁঠাল, আজুলি, কুম্ভী, গান্ধী গজারি

ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কৃত্রিমভাবে ইউক্যালিপটাস আর রাবারের বনায়ন করা হয়েছে এখানে।

 

ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের আকর্ষণীয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট । স্পটগুলো হলো আনন্দ, কাঞ্চন, সোনালু, অবকাশ, অবসর, বিনোদন। দর্শনার্থীদের আরামের জন্য রয়েছে বকুল, মালঞ্চ, মাধবী, চামেলী, বেলী, জুঁই নামের চমৎকার ও মনোরম কটেজ। এখানে ১৩টি কটেজ ও ছয়টি রেস্টহাউস রয়েছে। পিকনিক স্পট কিংবা রেস্ট হাউস ব্যবহার করতে হলে বন বিভাগের মহাখালী কার্যালয় থেকে আগাম বুকিং দিয়ে আসতে হয়। ঢাকার একেবারে কাছে হওয়ায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। পিকনিক বা পারিবারিকভাবে দলবদ্ধ ভ্রমণের জন্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানটি একটি সুন্দরতম স্থান। সবুজেঘেরা কোলাহলমুক্ত বনানী পরিবেশের জন্য এ উদ্যান বিখ্যাত। এই জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে  বয়ে গেছে অসংখ্য জলাশয়। এসব জলাশয়ে শৌখিন পর্যটকরাও নৌকায় করে বেড়াতে পারেন। এ ছাড়া বনভোজনের সেরা আকর্ষণ হচ্ছে এই ভাওয়ালের ন্যাশনাল পার্কটি। এ উদ্যানের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৬ টাকা। প্রাইভেট কার কিংবা মাইক্রোবাস নিয়ে প্রবেশ করতে লাগবে ৩০ টাকা আর মিনি বাসের

জন্য প্রবেশমূল্য ৫০ টাকা। তা ছাড়া পুরো বনের সৌন্দর্য এক সাথে দেখার জন্য রয়েছে একাধিক সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার, যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন হাজার হাজার বৃক্ষের পত্র পল্লব শোভীত সবুজের রাজ্যে।

 

আরো দেখতে পাবেন

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের অদূরেই ভাওয়াল রাজবাড়ি। গাজীপুর সদরে অবস্থিত প্রাচীন এ রাজবাড়ি। গড় দেখে হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন সেখানেও। জমিদার লোক নারায়ণ রায় বাড়িটির নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করেন রাজা কালী নারায়ণ রায়। প্রায় পনের একর জায়গাজুড়ে মূল ভবনটি বিস্তৃত। ভবনটির দক্ষিণ পাশে মূল প্রবেশপথ। মূল প্রবেশপথের পরই রয়েছে প্রশস্ত একটি বারান্দা এবং এর পরে একটি হল ঘর। ভবনের ওপরের তলায় ওঠার জন্য ছিল শাল কাঠের তৈরি প্রশস্ত সিঁড়ি। ভবনের উত্তর প্রান্তে খোলা জায়গায় রয়েছে নাটমণ্ডপ। রাজবাড়ির সব অনুষ্ঠান হতো এ মঞ্চে। রাজবাড়ির মধ্যে পশ্চিমাংশের দ্বিতল ভবনের নাম রাজবিলাস। এ ভবনের নিচে রাজার বিশ্রামাগারের নাম ছিল হাওয়ামহল। দক্ষিণ দিকে খোলা খিলান যুক্ত উন্মুক্ত কক্ষের নাম পদ্মনাভি। ভবনের দোতলার মধ্যবর্তী একটি কক্ষ ছিল রাণীমহল নামে পরিচিত। সুরম্য এ ভবনে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৩৬০টি কক্ষ আছে। তবে বর্তমানে এই রাজবাড়িটি ব্যবহৃত হচ্ছে জেলা পরিষদ কার্যালয় হিসেবে।

 

যাতায়াত

দেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে আপনি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান আসতে পারেন সহজেই। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ও গাজীপুর সদর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে জয়দেবপুরে ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কটি অবস্থিত।

ঢাকা ময়মনসিংহ সড়কের পাশে এ পার্ক অবস্থিত হওয়ায় অতি সহজে এবং ঢাকা থেকে অল্প সময়ে ঘুরে আসতে পারেন। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী যেকোনো বাসে চড়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের ফটকের সামনেই নামা যায়। এ ছাড়া ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি বাস এ পথে। ভাড়া ৫০-৬০ টাকা। তা ছাড়া আসতে পারেন নিজস্ব গাড়িতেও। এ ক্ষেত্রে জয়দেবপুর চৌরাস্তা ছাড়িয়ে অল্প কিছু দূর গেলে হাতের ডানে পেয়ে যাবেন প্রধান প্রবেশপথ, তারপর সরাসরি গহিন অরণ্যে!

সতর্কতা

দুই একজন এখানে বেড়াতে গেলে উদ্যানের বেশি গহিনে না যাওয়াই ভালো। একাকী গেলে ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে পারেন। জঙ্গলে ভ্রমণের সময় অবশ্যই আরামদায়ক কাপড় ও জুতো পরবেন, সাথে রাখবেন রোদ চশমা, টুপি ও পানির বোতল। বর্ষায় ভ্রমণে এলে সাথে রাখবেন রেইনকোট। দূরের পাখি দেখতে আনতে পারেন দূরবীন। জোঁক কিংবা কিটপতঙ্গ আপনার আনন্দের মধ্যে নুন ছিটাতে পারে। তাই প্যান্ট অবশ্যই গুজে নিন মুজোর ভেতর আর সাথে রাখুন পতঙ্গনাশক ক্রিম। বনের ভেতর একা না যাওয়াই শ্রেয়। পশু পাখি বিরক্ত হয় এমন শব্দ ও কোলাহল করা থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে এবং পলিথিন, ক্যান, প্লাস্টিকের বোতল ফেলে কোনোভাবেই বনকে ময়লা করবেন না এবং ধূমপানও করবেন না। অতঃপর, আপনার ভ্রমণ হোক আনন্দময় সেই কামনাই রইল।