ছুটির দিনে
একদিনে ঘুরে আসুন ফুলবাড়ীয়ার গ্রামীণ পর্যটন স্পটগুলো
শাল-গজারি, রাবার, বৃক্ষরাজিসহ বন্যপ্রাণীর অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সন্তোষপুর, মনোমুগ্ধকর আনই নদী, দেশের বৃহৎ বদ্ধ জলাশয় বড়বিলাসহ আদিবাসীদের বাসস্থান। এককথায় ভ্রমণবিলাসীদের আকর্ষণ করার জন্য সব উপাদান ছড়িয়ে আছে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়ায়।
বড়বিলার পদ্ম, শাপলা, শালুক, নৌকাভ্রমণ, রূপকথার গল্পের মতো আনই রাজার ভিটা, নিপুণ শিল্পীর হাতে তৈরি রাবার বাগান, প্রকৃতির সৃষ্টি অসংখ্য বৃক্ষরাজির সবুজ প্রকৃতিসহ সন্তোষপুর বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণী, আদিবাসীদের বাসস্থানসহ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠার সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগের অভাবে তা গড়ে উঠছে না।
৩৯৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে ফুলবাড়ীয়া উপজেলা। ১৮৬৭ সালে স্থাপিত হয় ফুলবাড়ীয়া থানা (বর্তমান উপজেলা)। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার দক্ষিণাঞ্চল রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত দেশের বৃহৎ বদ্ধ জলাশয় বড়বিলা। বড়বিলার ‘নবাইকুরি’ কিংবদন্তি কজনেই বা জানে। বড়বিলাতে অনেক কুরি রয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় ৩০০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে রহস্যঘেরা ‘নবাইকুরি’। বড়বিলার মনোমুগ্ধকর পরিবেশে পদ্ম, শাপলা, শালুক নৌকা ভ্রমণসহ শীতের আগমনে বিভিন্ন রঙের অতিথিপাখি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে তোলে। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে শত শত দর্শনার্থী আসে প্রকৃতির নিপুণ হাতে তৈরি সন্তোষপুর রাবার বাগান, বন্যপ্রাণী, আনই রাজার ভিটা, শতবর্ষী গোলাপকাঠ গাছসহ বড়বিলার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখতে। পর্যটকদের মতে, দর্শনীয় স্থানগুলোকে যদি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তাহলে প্রতিবছর সরকারের লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হবে।
আনই রাজার ভিটা
বড়বিলার পাশেই রয়েছে আনই রাজার ভিটা। জনশ্রুতি আছে, বহু আগে এ ভিটায় বাস করতেন এক রাজা। যার নাম ছিল আনই রাজা। শুনে মনে হবে রূপকথার গল্প। রূপকথা গল্প নয়, বাস্তব। জাঁকজমকপূর্ণ ছিল তাঁর রাজপ্রাসাদ। কিন্তু প্রতিবছরই তার রাজপ্রাসাদ প্রচণ্ড ঝড়ে ভেঙে দিত। তাই লোহা দিয়ে সুরক্ষিত রাজপ্রাসাদ তৈরি করে নিরাপত্তার জন্য চারদিকে খনন করা হয়েছিল একটি বিশাল আকৃতির খাল। সে খালই একসময় আনই রাজার প্রাসাদ ধ্বংসের জন্য হয়ে পড়ে কাল।
একদিন রাতে হঠাৎ প্রচণ্ডবেগে ঝড় শুরু হয়। প্রচণ্ডবেগের সেই ঝড় রাজপ্রাদের কোনোই ক্ষতি করতে পারে না। হঠাৎ আনই রাজা বাইরে মায়ের কণ্ঠ শুনতে পান। তাঁর মা আর্তকণ্ঠে দরজা খোলার আকুতি জানান। আনই রাজা তাঁর লোকজনকে দরজা খোলার নির্দেশ দেন। সুরক্ষিত লোহার দরজা খুলতেই প্রচণ্ডবেগের ঝড় লোহার প্রাসাদটি উড়িয়ে নিয়ে সেই খালে ডুবিয়ে দেয় বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।
রাবার বাগান ও বনবিট
উপজেলার কেশরগঞ্জ বাজার থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে আঁকাবাঁকা গ্রামীণ মেঠোপথ পেরোলে চোখে পড়বে নয়নাভিরাম পাহাড়ি বনাঞ্চল সন্তোষপুর। গ্রামটি ঘিরে রয়েছে বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের নিপুণ হাতে তৈরি রাবার বাগান। সবুজ বনায়ন ও প্রকৃতির সৌন্দর্য শাল-গজারিগাছ, বন্যপ্রাণী, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে যে কাউকে করে তুলবে ব্যাকুল। রাবারগাছ থেকে ট্রেপারদের (শ্রমিক) কষ আহরণের দৃশ্য এবং রাবার কষ থেকে রাবার উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে। বনবিটকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ শতাধিক বানর।
বনাঞ্চলের বানরগুলোকে দর্শনার্থীরা নামকরণ করেছে ‘সামাজিক বানর’। কারণ, বানরগুলো দর্শনার্থীদের মাথায় ও কাঁধে উঠে খাবার নেয়। ছোট শিশুরা বন্যপ্রাণীর সঙ্গে দুষ্টুমি করলেও কোনো কামড় বা আঁচড় দেয় না, যা দর্শনার্থীদের জন্যও হয়ে ওঠে উপভোগ্য। সেই দৃশ্য আপনি নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
যেভাবে যাবেন রাবার বাগান ও বনবিটে
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে আলম এশিয়া পরিবহনে (লোকাল সার্ভিস) সরাসরি চলে যেতে পারেন ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদরে। ভাড়া নেবে ১৮০ থেকে ২২০ টাকা। এ বাস সার্ভিসে গেলে সময় একটু বেশি লাগবে। সময় বাঁচাতে চাইলে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এনা পরিবহনে ২২০ টাকায় চলে যেতে পারবেন ময়মনসিংহের মাসকান্দা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে। সেখান থেকে ২০ কিলোমিটার ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদরে যেতে বাস বা সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর থেকে ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে নাওগাঁও ইউনিয়নে সন্তোষপুর রাবার বাগান ও বনবিট। রাবার বাগান পর্যন্ত পাকা সড়ক। রাবার বাগানের অফিস থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার কাঁচা মাটির সড়ক পেরিয়ে বনবিট অফিস। উপজেলা পরিষদের সামনে থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ভ্যানগাড়ি নিয়ে সরাসরি যেতে পারবেন রাবার বাগান ও বনবিটে। জনপ্রতি ভাড়া ৭০ থেকে ১০০ টাকা। খাওয়া-দাওয়া করতে পারবেন কেশরগঞ্জ বাজারের হোটেলগুলোতে।
অর্কিড ফুলের বাগান ও আলাদিনস পার্ক
লালমাটির পাহাড়ি নির্জন নিভৃত এলাকা এনায়েতপুর ইউনিয়নের দুলমা গ্রাম। এ গ্রামের রয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন দেশের বৃহৎ দীপ্ত অর্কিড ফুলের বাগান। অর্কিড বাগানে রয়েছে জারবেরাসহ নানা রঙের দেশি-বিদেশি ফুল ও ফলগাছ, যা অনেকেই দেখেননি। অর্কিড বাগানে যাওয়ার পথে দেখে যেতে পাবেন সেই ঐতিহ্যপূর্ণ ‘তমালতলা গুপ্তবৃন্দাবন’, যেখানে কৃষ্ণের অবতার হয়েছিল এবং গোপন লীলায় মত্ত থাকতেন কৃষ্ণ। যার ফলে এ গ্রামটি ‘গুপ্তবৃন্দাবন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে অর্কিড বাগান ঘুরে দেখতে চাইলে বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।
এ ইউনিয়নের আরেকটি অজপাড়াগাঁ বেতবাড়ী গ্রাম। লালমাটির আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। গ্রামটিতে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের বৃহৎ অত্যাধুনিক বিনোদনকেন্দ্র ‘আলাদিনস পার্ক’। পার্কের ভেতরে নারী-পুরুষ ও বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির ভাস্কর্য দেখতে অসাধারণ। রয়েছে অডিটরিয়াম, কটেজ, মোটেল, ফাস্টফুড অ্যান্ড চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, মুবিং রেস্টুরেন্ট, ওপেন থিয়েটার মঞ্চ, ওয়াটার ড্যান্সিং জোন, ওয়েবপুল, প্যাডেল বোট, মিনি চিড়িয়াখানা, হর্সকার, ড্যান্সিং বাম্পার কার, ট্রেন, আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকুয়ারিয়াম, শুটিং স্পট, পিকনিক স্পট, কফি হাউস, ওয়াটার ড্যান্সিং ঝরনা, লেক, আর্টিফিশিয়াল পাহাড়সহ অনেক কিছু।
যেভাবে যাবেন অর্কিড বাগান ও আলাদিনস পার্কে
ময়মনসিংহ সদর থেকে ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর। ময়মনসিংহ সদর থেকে অর্কিড বাগান ও আলাদিনস পার্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া জনপ্রতি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা লাগবে।
উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে আলাদিনস পার্ক এবং ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অর্কিড বাগান এনায়েতপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। সোয়াইতপুর লোহাশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পার্ক পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা রয়েছে।
আলাদিনস পার্কে রয়েছে পিকনিকেরও সুব্যবস্থা। রয়েছে থাকার জন্য কটেজও।
অন্যদিকে ঢাকা থেকে ভালুকা উপজেলা হয়ে গেলে অনেকটা সুবিধা হবে। সময় লাগবে অনেক কম। ভালুকা সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে ভরাডোবা বাজার। ভরাডোবা থেকে কাহালগাঁও অর্কিড বাগান। সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। অর্কিড বাগান থেকে আলাদিনস পার্ক যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট। ভালুকা থেকে আপনার গন্তব্য অর্কিড বাগান ও আলাদিনস পার্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বোচ্চ যানবাহন ভাড়া লাগবে ১১০ টাকা। খাওয়া-দাওয়া করতে পারবেন আছিম বাজার, সোয়াইতপুর বাজার ও কাহালগাঁও বাজারের ছোট হোটেলগুলোতে। ওখান থেকে ইচ্ছে করলে ঘুরে আসতে পারবেন বড়বিলা, আনই রাজার বিলুপ্ত বাড়ি ও রাবার বাগান।
সকালবেলা ঢাকা থেকে রওনা হয়ে সারা দিন পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে রাতেই ফিরে আসা যাবে ঢাকায়। খরচ হবে জনপ্রতি ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা।